রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় অসংখ্য তারার সমাহার। এদের মধ্যে বেশিরভাগই নক্ষত্র। তবে কিছু জায়গায় রয়েছে ঘনীভূত মহাজাগতিক মেঘ। মহাকাশের মেঘের এই চমকপ্রদ রহস্যের নামই হলো নীহারিকা বা নেবুলা (Nebula)। ‘নেবুলা‘ একটি ল্যাটিন শব্দ এবং এর আভিধানিক অর্থ ‘কুয়াশা বা মেঘ‘, আর বাংলায় একে বলা হয় ‘নীহারিকা’। নীহারিকা বা নেবুলা হলো ধুলা, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম ও আয়নিত গ্যাসের আন্তঃমহাকাশীয় মেঘ। আসলে যেকোনো মহাকাশীয় বস্তুর ছড়িয়ে যাওয়া অবস্থাকেই নীহারিকা বলা যায়। বস্তু বলতে তা একটি নক্ষত্র, এমনকি একটি ছায়াপথ বা গ্যালাক্সিও হতে পারে। আর এই নীহারিকা হলো নক্ষত্রের জন্মস্থান। এক্ষেত্রে মহাকর্ষের টানে গ্যাসীয় কণাগুলো একত্রিত হয়ে ধীরে ধীরে নক্ষত্র গঠন করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন বিজ্ঞানীরা গ্যালাক্সিগুলির আসল ধর্ম জানতেন না, তখন অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিকে অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকাও বলা হতো। প্রযুক্তির উন্নতিতে আজ আমরা জানতে পেরেছি তা নীহারিকা নয়, গ্যালাক্সি।


ক্রেডিট: NASA, ESA, এবং H. Bond and R. Ciardullo (Pennsylvania State University), ছবি প্রক্রিয়াকরণ: Gladys Kober (NASA/Catholic University of America)
কত বড়ো হতে পারে এই নীহারিকাগুলো? নীহারিকার গাঠনিক উপাদানগুলোই বা কী কী?
– নীহারিকা সাধারণত ০.১ আলোকবর্ষ (এক বছর সময় আলো যত পথ অতিক্রম করে তাকে ১ আলোকবর্ষ বলে। ১ আলোকবর্ষ = 9460000000000 কিলোমিটার) থেকে শুরু করে অনেক বৃহৎ এলাকা জুড়ে অবস্থান করে। যেমন: এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে ছোটো নীহারিকা NGC 7027 মাত্র ০.১ আলোকবর্ষ ও আবিষ্কৃত সর্ববৃহৎ ট্যারান্টুলা নেবুলা প্রায় ১৮৬২ আলোকবর্ষ জুড়ে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে দূরত্বের কারণে এদের ছোটো দেখা গেলেও মূলত নীহারিকা অনেক বড়ো! নীহারিকা প্রধানত গ্যাস, ধুলা ও প্লাজমা দ্বারা গঠিত। অধিকাংশ নীহারিকাতেই ৯০% হাইড্রোজেন, ৯% হিলিয়াম, এছাড়া বাকি ১% হিসেবে রয়েছে কার্বন, নাইট্রোজেন, ম্যাগনেশিয়াম, সালফার, ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম। নীহারিকাগুলো মূলত অবস্থিত আন্তঃনাক্ষত্রিক শূন্যস্থান বা interstellar medium (ISM) -এ। অর্থাৎ দুটি নক্ষত্রের মধ্যে বিদ্যমান ফাঁকা জায়গায়।
নীহারিকার জন্ম কিন্তু খুব সাদাসিধেভাবে হয় না। অনেক সময় প্রয়োজন হয় এদের সৃষ্টির জন্য। আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যমে থাকে অনেক গ্যাস ও ধুলা। কোনোভাবে মহাকর্ষ টানের মাধ্যমে যখন সেগুলো কাছাকাছি আসে তখন কাছাকাছি আসা সেসব গ্যাসের সম্মিলিত আকর্ষণ আরও শক্তিশালী হয়। ফলে সেগুলো আরও বেশি পরিমাণ পদার্থকে আকর্ষণ করতে থাকে, সংকুচিত করতে থাকে। এভাবে পদার্থ যতো কাছাকাছি আসে, আকর্ষণ ততই বাড়ে, এভাবে বাড়তে বাড়তে অনেক বিশাল পরিমাণ গ্যাসীয় অঞ্চলের সৃষ্টি হয় যাকে নীহারিকা বলে৷ অনেক নীহারিকার সৃষ্টি হয় নক্ষত্র থেকে। অল্প জীবনকালের কিছু ভারী নক্ষত্রের জীবন শেষ হয় বিশাল এক বিস্ফোরণের মাধ্যমে। এ ধরনের নক্ষত্রকে বলে সুপারনোভা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে তারার বাইরের অংশ ধুলো, গ্যাস আর বিপুল পরিমাণ শক্তি অবমুক্ত করে। বিস্ফোরণের ফলে যে শক্তি নির্গত হয়, তা আশেপাশের গ্যাসগুলোতে আয়নিত করে ফেলে। তখন পুরো এলাকাটিকে উজ্জ্বল দেখায়। এভাবে সুপারনোভার ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম হয় এই নীহারিকার। আবার এই নীহারিকাই হলো নক্ষত্রের একমাত্র জন্মস্থান৷ নীহারিকার গ্যাস ও ধুলাই মহাকর্ষীয় টানে সংকুচিত হয়ে নক্ষত্রের জন্ম দেয়। আবার সেই নক্ষত্রই মৃত্যুর সময় নীহারিকা সৃষ্টি করে, আবার সেই নীহারিকা থেকেও আবার সৃষ্টি হয় নক্ষত্র। এভাবেই নীহারিকার জগতে চলতে থাকে ভাঙা-গড়ার খেলা। শেষ পর্যন্ত বলা যায়, আন্তঃনাক্ষত্রিক উপাদানগুলো যখন মহাকর্ষীয় সংবন্ধন (Gravitational Collapse)-এর মধ্য দিয়ে যায়, তখন নীহারিকা গঠিত হয়।


ক্রেডিট: NASA, ESA, and J. Kastner (RIT)
সর্বপ্রথম ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত গ্রিক জ্যোতির্বিদ ক্লডিয়াস টলেমি তাঁর বিখ্যাত ‘আলমাজেস্ট’ গ্রন্থে নীহারিকার কথা লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি পাঁচটি আবছায়া তারা দেখতে পেয়েছেন। তিনি এটাও লিখেছিলেন যে, সপ্তর্ষি (Ursa Major) এবং সিংহ (Leo) নক্ষত্রমণ্ডলীর মাঝখানে তারাবিহীন একটি মেঘাচ্ছন্ন এলাকা দেখেছেন। সেখান থেকেই নীহারিকার জ্ঞানের জন্ম। অবশ্য সর্বপ্রথম সত্যিকারের নীহারিকার কথা উল্লেখ করেন পার্সিয়ান (বর্তমান ইরান) জ্যোতির্বিদ আব্দুর রহমান আল-সুফী তার Book of Fixed Stars (كتاب صور الكواكب) বইয়ে। তিনি অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথের কাছেই একটা মেঘাচ্ছন্ন অঞ্চল দেখতে পান। ২৬ নভেম্বর ১৬১০ সাল, ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস-ক্লদ ফ্যাবরি টেলিস্কোপ দ্বারা প্রথম ‘কালপুরুষ (Orion)’ নীহারিকা আবিষ্কার করেন। এরপর আরও অনেক জ্যোতির্বিদ বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন নীহারিকা আবিষ্কার করেন।


উৎস: Bodeian Library
নীহারিকা অনেক প্রকারের হয়ে থাকে। কিছু নীহারিকা নিজস্ব আলো দেয়, কিছু নীহারিকাকে অন্ধকার দেখায়, কিছু বা আবার গোলাকৃতি। প্রধানত নীহারিকাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। এদের সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
১) এইচ টু অঞ্চল (H II regions):
নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাইড্রোজেন নিয়ে কিছু একটু হবে। এসলেই তাই। ‘এইচ টু’ অঞ্চলের নীহারিকাগুলো বেশিরভাগই আয়নিত হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত। এগুলো বিভিন্ন আকার-আকৃতির হয়ে থাকে। কখনো নীহারিকাগুলো একসাথে অবস্থান করে আবার কখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করে। এই অঞ্চলের নীহারিকাগুলো থেকে সবসময় নতুন নক্ষত্র তৈরি হতে থাকে। তাই এদের ‘নক্ষত্র সৃষ্টির অঞ্চল’ও বলা হয়। সময়ের সাথে সাথে যখন নক্ষত্রের মৃত্যু ঘটে তখন এই অঞ্চলের গ্যাসগুলো ছড়িয়ে পড়ে এবং সৃষ্টি করে সাতবোন বা প্লাইয়েডসের (pleiades) মতো বিভিন্ন স্টার ক্লাস্টারের। ঈগল নেবুলার ‘পিলারস্ অভ ক্রিয়েশন’ অংশটিও ‘এইচ টু’ অঞ্চলে অবস্থিত!


ক্রেডিট: NASA/CXC/CfA/R. Tuellmann (এক্স-রে), NASA/AURA/STScI/J. Schmidt (অপটিক্যাল)
২) প্ল্যানেটারি নেবুলা (Planetary nebula):
ইংরেজি ‘Planet’ শব্দের অর্থ ‘গ্রহ’। অনেকের মনে হতে পারে এই নীহারিকার সাথে গ্রহের কোনো সংযুক্তি আছে। কিন্তু না। এর নামের সাথে এর প্রকৃতির কোনোই মিল নেই। এ নীহারিকা মূলত গোলাকার গ্যাসের শেল দ্বারা গঠিত। এদের এই গোলাকার আকৃতির জন্যে নীহারিকাগুলোকে বৃহৎ গ্রহের মতো দেখায়৷ তাই এদের এরকম নামকরণ করা হয়েছে৷ যখন কোনো মধ্যম ভরের নক্ষত্রের জীবদ্দশার শেষ পর্যায়ে তা বিস্ফোরিত হয়ে তার পৃষ্ঠের অংশ বাইরে নিক্ষিপ্ত করে, তখন সেসব অংশই গোলাকার শেলের আকৃতি হয়ে এমন নীহারিকার সৃষ্টি করে। নক্ষত্রটির আকার কমে যাওয়ায় এর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় তখন। আর তখন তা থেকে অতিবেগুনী রশ্মি নির্গত হতে থাকে। এ রশ্মি পরবর্তীতে নীহারিকার গ্যাসকে আয়নিত করতে থাকে। এক পর্যায়ে প্ল্যানেটারি নেবুলাও আলো বিকিরণ করতে শুরু করে, কিন্তু তা পুরোপুরি এমিশন (নিচে এমিশন নেবুলা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে) নেবুলার মতো হতে পারে না। কারণ, এমিশন নেবুলার তুলনায় প্ল্যানেটারির ঘনত্ব থাকে অনেক কম। আর নেবুলাটির কেন্দ্রে থাকা নক্ষত্রটির আলোতেই নেবুলাটি আলোকিত হয়। প্ল্যানেটারি নেবুলার কিছু উদাহরণ হলো: রিং নেবুলা, হেলিক্স নেবুলা। এছাড়া ভবিশ্যতে আরেকটি উদাহরণ হবে আমাদের সূর্য; একটি মধ্যম ভরের নক্ষত্র। এটি যখন ভবিষ্যতে বিস্ফোরিত হবে তখন তা খুব সুন্দর একটি প্ল্যানেটারি নেবুলার সৃষ্টি করবে৷ প্ল্যানেটারি নেবুলাগুলো বেশ দ্রুত গতিতে প্রসারিত হতে থাকে। এদের গড় তাপমাত্রা থাকে ১০,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু কেন্দ্রের নক্ষত্রের তাপমাত্রা থাকে অনেক বেশি, ২৫,০০০ থেকে ২ লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।


ক্রেডিট: ESA, NASA, HEIC, এবং The Hubble Heritage Team (STScI/AURA)
৩) সুপারনোভা রেমন্যান্ট (Supernova remnant):
যেসব নক্ষত্রের ভর সাধারণত সূর্যের ৮ থেকে ১৫ গুণ বা তারচেয়েও বেশি সেগুলো তাদের জীবদ্দশার শেষের দিকে এক তীব্র বিস্ফোরণ ঘটায়, এতে প্রচণ্ড শকওয়েভ সৃষ্টি হয় এবং এর পৃষ্ঠের গ্যাসীয় উপাদানসমূহকে তীব্র বেগে শূন্যে নিক্ষিপ্ত হয়। এসব উপাদানসমূহ পরবর্তীতে সমন্বিতভাবে নেবুলার রূপ লাভ করে। এদেরকে supernova remnant (SNR) বলা হয়। এসব গ্যাসীয় উপাদানগুলো কেন্দ্রে থাকা উচ্চভরের ও উচ্চতাপমাত্রার নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত হতে থাকে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ: ক্র্যাব নেবুলা, যার কেন্দ্রে রয়েছে ক্র্যাব পালসার।


ক্রেডিট: NASA/ESA/HEIC এবং The Hubble Heritage Team (STScI/AURA)
৪) ডার্ক নেবুলা:
নামের সাথে এই নীহারিকাগুলোর মিল বলতে গেলে পুরোটাই। যেন বিশাল আকারের কালো মেঘ! এ নীহারিকা অনেক ঘন আন্তঃনাক্ষত্রিক মেঘ দ্বারা গঠিত৷ এই মেঘ এতোটাই ঘন হয় যে, এদের নিকটবর্তী পেছনের বা পাশের নক্ষত্র থেকে বিকিরিত আলো এ ঘন মেঘ ভেদ করে আসতে পারে না, বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে এদেরকে অন্ধকার দেখায়। তাই এদের নাম ডার্ক বা অন্ধকার নীহারিকা।


ক্রেডিট: T.A.Rector (NOIRLab/NSF/AURA) এবং Hubble Heritage Team (STScI/AURA/NASA)
এতে থাকে হাইড্রোজেন অণু, হিলিয়াম পরমাণু, অক্সিজেন, অ্যামোনিয়া; এদেরকে সাধারণভাবে অন্যান্য নীহারিকার মতো দেখায় না। এদেরকে বোঝা যায়, কোনো আলোকিত অঞ্চলের মাঝে অন্ধকারময় স্থানরূপে। এদের সাধারণত এমিশন ও রিফ্লেকশন নেবুলার সাথে অবস্থান করতে দেখা যায়। সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হলো ‘হর্সহেড নেবুলা’, যা ওরিয়ন নেবুলার কাছে অবস্থিত। একে ওরিয়ন নেবুলার কাছে অন্ধকারময় দেখায়, যা একটি ঘোড়ার মাথা আকৃতির৷ তাই একে হর্সহেড নেবুলা নামকরণ করা হয়েছে৷ এদের গড় তাপমাত্রা থাকে খুবই কম, মাত্র ১০ থেকে ১০০ কেলভিন।


ক্রেডিট: ESO
এছাড়াও নীহারিকার আরও অনেক প্রকারের উপবিভাগ রয়েছে। এগুলো হলো:
৫) ডিফিউজ নেবুলা (Diffuse nebula):
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই নীহারিকার কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই, অর্থাৎ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে। মহাশূন্যের বেশিরভাগ নীহারিকাই এই প্রকারভেদের মধ্যে পড়ে। ডিফিউজ নেবুলাগুলোকে দেখতে মনে হয় মহাকাশে ছড়িয়ে পড়া কোনো গ্যাসীয় পদার্থ। এদের সীমা নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয় না। ডিফিউজ বা বিস্তীর্ণ নীহারিকাগুলো প্রচুর পরিমাণে অবলোহিত আলো (IR) নির্গত করে যা তাদের নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত দৃশ্যমান করতে সাহায্য করে; কিন্তু পুরোটা নয়।
সাধারণত এমিশন নেবুলা, রিফ্লেকশন নেবুলা এবং ডার্ক নেবুলাগুলো ডিফিউজ নেবুলার অংশ।
৬) এমিশন নেবুলা (Emission nebula):
এমিশন নেবুলা মূলত আয়নিত গ্যাসীয় কণা দ্বারা গঠিত, যা মূলত বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকিরণ করে৷ এই আয়নিত গ্যাস বলতে থাকে মূলত হাইড্রোজেন গ্যাস। তবে অন্যান্য গ্যাসীয় উপাদানও থাকে। এখানকার হাইড্রোজেন গ্যাস আয়নিত হওয়ার প্রধান উৎস মূলত এর নিকটবর্তী উত্তপ্ত নক্ষত্রসমূহ৷ কারণ, এদের নিকটবর্তী উত্তপ্ত নক্ষত্রগুলো থেকে বিকিরিত অতিবেগুনি রশ্মি এ নীহারিকার হাইড্রোজেন গ্যাসকে আয়নিত করে ফেলে, এবং এই আয়নিত হাইড্রোজেন গ্যাসীয় কণা আলোক বিকিরণ করে। আলো বিকিরণ করে বিধায় এদের বলা হয় Emission Nebula বা বিকিরণ নীহারিকা। মহাকাশের এ ধরনের নীহারিকার অঞ্চলগুলোকে মূলত নক্ষত্রের আদর্শ জন্মস্থান বলা চলে৷ কারণ এখানকার গ্যাস, ধুলা এতো পরিমাণে থাকে যে গ্র্যাভিটির টানে সেগুলো কেন্দ্রীভূত হয়ে খুব সহজেই নক্ষত্রের জন্ম দিতে পারে। আর যে ধূলিময় অংশ থাকে তা গ্রহের জন্ম দিতে পারে, যা সে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরতে পারে৷ ওরিয়ন নেবুলা, ঈগল নেবুলা এ ধরনের নীহারিকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ওরিয়ন নেবুলা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির নক্ষত্রের জন্মের সবচেয়ে বেশি সক্রিয় অঞ্চল। ওরিয়ন নেবুলার কমলা রঙের জন্যে দায়ী হাইড্রোজেন, লাল রঙের জন্যে দায়ী সালফার, সবুজ রঙের জন্যে দায়ী অক্সিজেন। মহাকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বলতম নেবুলা হলো এই এমিশন নেবুলাগুলো৷ এদেরকে বেশ খালি চোখেই দেখা যায়, তবে ছোটো টেলিস্কোপেও এদের বেশ স্পষ্ট দেখায়। এদের গড় তাপমাত্রা থাকে ২৫,০০০ থেকে ১,৫০,০০০ কেলভিন পর্যন্ত৷


ক্রেডিট: NASA, ESA and the Hubble Heritage (STScI/AURA)-ESA/Hubble Collaboration
৭) রিফ্লেকশন নেবুলা (Reflection nebula):
এ ধরনের নীহারিকাগুলো মূলত আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধুলার মেঘ দ্বারা গঠিত। এদেরকে রিফ্লেকশন বা প্রতিফলন নীহারিকা বলার কারণ, এদের নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে বিকিরিত আলো এদের গ্যাসীয় উপাদানগুলো খুব উজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত করে। কিন্তু সেসব নক্ষত্র থেকে বিকিরিত আলোকশক্তি ততোটা শক্তিশালী হয় না যাতে এ নীহারিকার গ্যাসগুলোকে আয়নিত করে বিকিরণ নীহারিকার সৃষ্টি করবে। এদেরকে ঠিক ততোটাই উজ্জ্বল দেখায়; নিকটবর্তী নক্ষত্র থেকে আসা যতটা আলো এরা বিক্ষেপণ করে। এদেরকে সাধারণত নীল রঙের দেখায়, কারণ নীল রং খুব সহজেই বেশি পরিমাণে বিক্ষিপ্ত হয়। ট্রিফিড নেবুলা এ ধরনের নীহারিকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এদের গড় তাপমাত্রা থাকে প্রায় ১০,০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।


ক্রেডিট: NASA and The Hubble Heritage Team (STScI)
৮) প্রোটো-প্ল্যানেটারি নেবুলা (Protoplanetary nebula):
কোনো প্রধান ধারার নক্ষত্র যখন ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে শ্বেত বামনে পরিণত হয়, তখন সেই অন্তর্বর্তী সময়ে এই জাতীয় নীহারিকার সৃষ্টি হয়। যখন কোনো নক্ষত্র তার জীবনকাল শেষ করে, তখন নক্ষত্র প্রচুর পরিমাণ ভর হারায়। এর ফলে নক্ষত্রের বাইরের হাইড্রোজেনের খোলস হালকা হয়ে যায়। একসময় এই নক্ষত্র হাইড্রোজেনের খোলস মুক্ত হয়ে নগ্ন হয়ে যায়। এই অবস্থায় নক্ষত্রকে ঘিরে হাইড্রোজেনের হালকা কুয়াশা থেকে যায়। নক্ষত্রের এই দশাতে দূর থেকে কুয়াশাঘন আবরণের ভিতর দিয়ে নক্ষত্রকে রঙিন দেখায়। নক্ষত্রের দশাকেই প্রোটোপ্ল্যানেটারি নেবুলা বা প্রাক্-গ্রহান্বিত নীহারিকা বলা হয়।


ক্রেডিট: NASA/ESA/Valentin Bujarrabal (National Astronomical Observatory, Spain)
৯) বাইপোলার নেবুলা (Bipolar nebula):
মূলত প্ল্যানেটারি নেবুলার একটি উপ-বিভাগ হলো বাইপোলার নেবুলা। যদি কোনো প্ল্যানেটারি নেবুলার আকৃতি বাইপোলার বা দ্বিপদী আকৃতির হয় তবে তাকে বলে বাইপোলার নেবুলা। এই নীহারিকাগুলো দুইপাশে প্রজাপতির ডানার মতো ছড়িয়ে থাকে। প্ল্যানেটারি নেবুলার প্রায় ১০-২০% হলো বাইপোলার নেবুলা। যদিও বাইপোলার নেবুলা সৃষ্টির প্রকৃত কারণ জানা যায়নি, তবে মূলত পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি নক্ষত্র যখন তাদের বাইরের লেয়ারের বিস্ফোরণের মাধ্যমে একসাথে নীহারিকায় পরিণত হয় তখনই বাইপোলার নেবুলা সৃষ্টি হয়। বাইপোলার নেবুলার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ‘বাটারফ্লাই নেবুলা’ বা ‘প্রজাপতি নীহারিকা’।


ক্রেডিট: NASA/ESA/Hubble
১০) পালসার উইন্ড নেবুলা (Pulsar wind nebula):
পালসার উইন্ড নেবুলা সাধারণত সুপারনোভা বিস্ফোরণের পর এর ভেতর থেকে উৎপন্ন হয়। একটি নক্ষত্রের মৃত্যুর পর বিভিন্ন দশা শেষ করে তৈরি হয় এই পালসার উইন্ড নেবুলা। মূলত সুপারনোভা রেমন্যান্টের মধ্যে অবস্থান করে এই নীহারিকাগুলো উজ্জ্বলতা প্রদর্শন করে। এই নীহারিকাগুলোকে অনেক সময় পুরোনো পালসারের পাশে খুঁজে পাওয়া যায়। মহাবিশ্বে খুব কম সংখ্যক ‘পালসার উইন্ড নেবুলা’ রয়েছে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হলো: ক্র্যাব নেবুলা।
এছাড়াও এরকম প্রবন্ধ
এছাড়াও মহাকাশের গ্যালাক্সি গুলো জুড়ে রয়েছে আরো অনেক ধরণের নীহারিকা। যাদের কথা বললে শেষ হবে না। এই রহস্য ঘেরা আকর্ষণ আমাদের ভাবিয়েছে প্রাচীন যুগ থেকে আজকের দিন অবধি। এখনো হয়ত কেউ নতুন নীহারিকার সন্ধানে মহাকাশের দিকে টেলিস্কোপ কাঁত করে রেখেছে। আমাদের প্রযুক্তি আরো যত উন্নত হবে মহাবিশ্বের রহস্য গুলো তত তারাতারি উৎঘাটিত হবে। নীহারিকা নিয়ে হয়ত জ্যোতির্বিজ্ঞানে আরো নতুন দ্বার উন্মচিত হবে। নক্ষত্রে ঠাঁসা, নক্ষত্রের আলোয় আলোকিত সুবিশাল মহাকাশের সৌন্দর্যরাজিতে নীহারিকার অবস্থান একদমই অনন্য।
নীহারিকা সম্পর্কে কিছু তথ্য:
১. মহাবিশ্বের সবচেয়ে ছোটো নীহারিকা হলো ‘এনজিসি ৭০২৭ (NGC 7027)’ যার ব্যাস মাত্র ০.১ আলোকবর্ষ।
২. আমাদের পরিচিত মহাবিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম স্থান ‘বুমেরাং নীহারিকা (PGC 3074547)’ অঞ্চলে অবস্থিত। এখানকার তাপমাত্রা -২৭২.১৫° সেলসিয়াস যা পরমশূন্য তাপমাত্রার চেয়ে মাত্র ১ ডিগ্রি বেশি।
৩. পৃথিবী থেকে সবচেয়ে কাছের নীহারিকা হলো ‘হেলিক্স নীহারিকা’ যা পৃথিবী থেকে ৬৯৪.৭ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
৪. ১৯২০ সালের আগ পর্যন্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূরবর্তী ছায়াপথগুলোকেও নীহারিকা হিসেবে মনে করতেন।
৫. এখন থেকে ৫ বিলিয়ন বছর পর আমাদের সূর্যও নীহারিকায় পরিণত হবে।
তথ্যসুত্র:
উত্তর দিন