নক্ষত্রের জীবন: একটি নক্ষত্রের জন্ম, মৃত্যু ও মৃত্যু পরবর্তী চক্রের সহজপাঠ

রাতের আকাশে তাকালে দেখতে পাই ছোটো ছোটো কুপিবাতির মতো জ্বলছে কিছু বিন্দু। এরা অনেকেই সূর্যের চেয়ে বিশাল, কিন্তু এদের অবস্থান অনেক দূরে হওয়ায় ছোটো বিন্দুর মতো দেখা যায়। এরাই হলো নক্ষত্র, যারা এই নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাবিশ্বকে নিরন্তর আলোকিত করে যাচ্ছে।

নক্ষত্রের জীবনচক্র

নক্ষত্রের জন্ম:

নক্ষত্রের নিজস্ব আলো আছে, আমরা সবাই জানি। কোথা থেকে এলো সেই আলো? – নক্ষত্রের জন্ম হয় বিশালাকার গ্যাসীয় বস্তুপুঞ্জ দ্বারা তৈরি বিশাল মহাজাগতিক মেঘ বা মলিকিউলার ক্লাউড থেকে। এর কিছু কিছু অঞ্চলে গ্যাসপুঞ্জ অধিক ঘনীভূত অবস্থায় থাকে যা নেবুলা বা নীহারিকা নামেও পরিচিত হয়। এই মলিকিউলার ক্লাউডের নীহারিকাগুলোই নক্ষত্রের জন্মস্থান।

এই নীহারিকাগুলোর মধ্যে থাকে ৪৫%-৭৫% হাইড্রোজেন, ২০%-৩৫% হিলিয়াম ও ৫% অন্যান্য বস্তুপুঞ্জ। একসময় নীহারিকার কিছু অঞ্চল (যেখানে গ্যাসের ঘনত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি) আপন মহাকর্ষের প্রভাবে সংকুচিত হতে থাকে এবং গ্যাসীয় গোলক তৈরি করতে থাকে। এই বল সদৃশ অংশটিকে তখন আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায় এবং একে বলা হয় প্রোটোস্টার বা শিশু নক্ষত্র। এটি নক্ষত্রের জন্মের প্রথম ধাপ। পরবর্তী সময়ে প্রোটোস্টার হয় নক্ষত্রের সুগঠিত কেন্দ্র।

জেমস ওয়েব স্পেইস টেলিস্কোপে তোলা L1527 নামের প্রোটোস্টার বা শিশু নক্ষত্র বা আদ্যনক্ষত্রের ছবি।ক্রেডিট: NASA/ESA/CSA/STScI/J. DePasquale (STScI)
জেমস ওয়েব স্পেইস টেলিস্কোপে তোলা L1527 নামের প্রোটোস্টার বা শিশু নক্ষত্র বা আদ্যনক্ষত্রের ছবি।
ক্রেডিট: NASA/ESA/CSA/STScI/J. DePasquale (STScI)

মহাকর্ষের প্রভাবে কেন্দ্রে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস আবদ্ধ হয় এবং তাকে ঘিরে বাইরের গ্যাসসমূহ আকর্ষিত হতে থাকে এবং নক্ষত্রটিতে ভর যোগ হতে থাকে। ক্লাউডের আয়তনের ওপর ভিত্তি করে ছোটো, মাঝারি বা বড়ো মাপের নক্ষত্র তৈরি হয়। কেন্দ্রকে ঘিরে নক্ষত্রের সারফেস বা উপরিভাগ তৈরি হতে থাকে। কেন্দ্রে গ্যাসসমূহ অধিক ঘনীভূত থাকে বলে কেন্দ্রের ভর পুরো নক্ষত্রের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি হয় এবং তীব্র তাপ ও চাপ উৎপন্ন হয়।

লক্ষ-লক্ষ বছর পরে তীব্র তাপ ও চাপের কারণে কেন্দ্রে থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন আরম্ভ হয় এবং ফিউশন প্রক্রিয়ায় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম প্রস্তুত হতে থাকে। ছড়িয়ে পড়ে নক্ষত্রের আলো ও তাপ। ততদিনে কেন্দ্রকে ঘিরে আকর্ষিত হতে থাকা গ্যাসের ডিস্কসমূহ মহাকর্ষের প্রভাবে জুড়ে গিয়ে নক্ষত্রের সারফেস তথা উপরিভাগ গঠন করে ফেলেছে। তৈরি হয়েছে একটি নক্ষত্র।

থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণু প্রচুর তাপে একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে এবং আলো ও প্রচুর শক্তি নির্গত হয়।
থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে হাইড্রোজেন পরমাণু প্রচুর তাপে একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে এবং আলো ও প্রচুর শক্তি নির্গত হয়।

থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন আস্তে আস্তে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি পূর্ণাঙ্গ হাইড্রোজেন বার্নিং স্টার গঠিত হয়। দিতে থাকে তাপ ও আলো।

জীবন ও যৌবন:

যৌবনকালে সবকিছুই তেজস্বী থাকে। নক্ষত্রেরও একই দশা।
নক্ষত্রের পুরো জীবনব্যাপী ফিউশন চলাকালীন বিস্ফোরণের বহির্মুখী চাপ ও মহাকর্ষ বলের মধ্যে সাম্য বজায় থাকে। ফলে নক্ষত্রটি সংকুচিত কিংবা প্রসারিত হয় না। কোটি-কোটি বছর ধরে দিতে থাকে তাপ ও আলো।

বার্ধক্য ও শেষ পরিণতি:

নক্ষত্রের ফিউশনের ফলে প্রতিনিয়ত ভর হারাতে থাকে।
ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি শেষ হতে থাকে। হাইড্রোজেন কমে যাওয়ায় ফিউশনের হার কমে যায়। তখন বিস্ফোরণ ও মহাকর্ষ বলের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে নক্ষত্রের তিনটি শেষ পরিণতি দেখা যায়। হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন, নিউট্রন স্টার বা নিউট্রন তারকা, ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। তারাগুলোর শেষ পরিণতি বোঝা যায় চন্দ্রশেখর লিমিট থেকে। আমাদের সূর্যের ভরকে বলা হয় ১ সৌরভর বা 1M

১৯৩০ সালে ভারতীয়-মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর হিসাব করে চন্দ্রশেখর লিমিট-এর মাণ বের করেন।Image Credit: University of Chicago Press
১৯৩০ সালে ভারতীয়-মার্কিন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখর হিসাব করে চন্দ্রশেখর লিমিট-এর মাণ বের করেন।
Image Credit: University of Chicago Press

চন্দ্রশেখর প্রমাণ করে দেখান যে, সংকুচিত হওয়ার পর নক্ষত্রের কেন্দ্রের ভর সর্বোচ্চ 1.4M পর্যন্ত হলে তা একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন হবে। কেন্দ্রের ভর 1.5M থেকে 3M হলে হবে নিউট্রন স্টার ও এর চাইতে বেশি হলে পরিণত হবে ব্ল্যাক হোলে।

মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা

হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন:

মহাকর্ষ ও ফিউশনের মধ্যকার ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রটি তীব্র মহাকর্ষের প্রভাবে আবার সংকুচিত ও উত্তপ্ত হতে থাকে এবং বাকি থাকা হাইড্রোজেনকে আরও দ্রুত ফিউজ করে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। এই গতিশক্তি নক্ষত্রের উপরিভাগকে বাইরের দিকে ঠেলতে থাকে। নক্ষত্রটি সম্প্রসারিত হয়। আমাদের সূর্যের মতো মাঝারি বা ছোটো মাপের তারাগুলো এ প্রক্রিয়ায় রেড জায়ান্ট বা লাল দানব-এ পরিণত হয়। নক্ষত্রটির আকার তার আগের চেয়ে অনেকগুণ বেশি বৃদ্ধি পায়। সূর্যের মতো তারাগুলোর প্রসারণের হার বেড়ে গেলে উপরিভাগকে মহাকাশে ছড়িয়ে দেয় এবং জন্ম হয় প্ল্যানেটরি নেবুলার। বাকি থাকে অত্যন্ত উত্তপ্ত, ঘনীভূত, তীব্র মহাকর্ষ বিশিষ্ট কেন্দ্র। কেন্দ্র এত বেশি উত্তপ্ত হয় যে এটি হাইড্রোজেন থেকে প্রস্তুত করা হিলিয়ামকেও ফিউজ করার সক্ষমতা অর্জন করে। হিলিয়াম থেকে পর্যায়ক্রমে কার্বন, অক্সিজেন, সিলিকন ও আয়রন উৎপন্ন করে।

1.4M বা তার কম ভরের সংকুচিত নক্ষত্রগুলো কার্বন বা অক্সিজেন পর্যন্ত ফিউজড হয়ে স্থিতিশীল হয়ে যায়। এরপর কার্বন ও অক্সিজেন দ্বারা গঠিত মৃত নক্ষত্রটিতে আর কোনো ফিউশন হয় না এবং এটি ধীরে ধীরে তাপ ও আলো বিকিরণ করে ঠান্ডা হতে থাকে। একটি শ্বেত বামনের এই ঠান্ডা হওয়ার প্রক্রিয়া অনেক ধীর, তাই এটি অনেক দিন পর্যন্ত আলো দেয়। এদের মহাবিশ্বের সম্ভাব্য শেষ আলোর উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর পদার্থ এত ঘনীভূত অবস্থায় থাকে যে এক চামচ পদার্থের ভর হবে ১৫ টনেরও বেশি। এর মহাকর্ষও অনেক বেশি হওয়ায় যে-কোনো কিছু এর উপর রাখলে তা চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।

নিউট্রন স্টার:

1.4M থেকে 3M এর সমান কেন্দ্রবিশিষ্ট তারাগুলোর প্রসারণ হার অনেক বেশি হয়। এরা বাইরের আবরণকে তীব্র গতিতে মহাকাশে ছড়িয়ে দেয়, যাকে আমরা সুপারনোভা এক্সপ্লোশন বা অতিতারকা বিস্ফোরণ নামে চিনি। এরপর বাকি থাকা কেন্দ্রটি শ্বেত বামনের মতো একই প্রক্রিয়ায় সংকুচিত হতে থাকে। কেন্দ্রটি এত উত্তপ্ত হয় যে তা কার্বন ও অক্সিজেন ফিউশনের পর সিলিকন ও আয়রন সৃষ্টি করে। এরপর স্থিতিশীল হয়ে সংকুচিত হতে থাকে। তীব্র মহাকর্ষের ফলে পরমাণুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রন ও নিউক্লিয়াসের ফাঁকা স্থান দূর হয়ে যায়। একে বলা হয় ইলেকট্রন ডিজেনারেসি।
ইলেকট্রন ডিজেনারেসির ফলে ইলেকট্রন ও প্রোটন মিলে নিউট্রন গঠিত হয়। নক্ষত্রটিতে তখন শুধু নিউট্রন ঠাসাঠাসি করে নিউক্লিয়োপাস্তার আকারে থাকে। তাই এর নাম নিউট্রন স্টার। নিউট্রন স্টারের এক চামচ পদার্থের ওজন কয়েক বিলিয়ন টন হতে পারে। এর আকর্ষণ বল শ্বেত বামনের চেয়েও অনেক বেশি যা আপনাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দেবে।
নিউট্রন স্টার খুব দ্রুত ঘোরে এবং এদের উপরিভাগের তাপমাত্রা 1011 থেকে 1012 কেলভিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা অনেক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন:

পালসার: যারা কিছু সময় পর পর তীব্র রেডিয়েশন পালস নির্গত করে।

ম্যাগনেটার: বড় আকৃতির নিউট্রন স্টার।

বাইনারি নিউট্রন স্টার: দুটি নিউট্রন স্টার একে অপরকে ঘিরে আবর্তন করে।

ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর:

এবার আসি সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং তারকার বিষয়ে যার ব্যাপারে আমাদের আগ্রহের কোনো কমতি নেই। সংকুচিত তারার ভর 3M এর বেশি হলে সুপারনোভার পর নিউট্রন স্টারের মতো প্রক্রিয়াই অনুসরণ করে। কিন্তু এদের ভর অত্যধিক বেশি হওয়ায় সংকুচিত হওয়ার পর তীব্র ভরের প্রভাবে এরা আরও বেশি সংকুচিত হয়। এতটাই সংকুচিত হয় যে, সমস্ত ভর একটি ক্ষুদ্র জায়গাতেই কেন্দ্রীভূত থাকে, যাকে বলা হয় সিঙ্গুলারিটি। এর আকর্ষণ বল এত বেশি যে একটি নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত এটি সব বস্তুকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে, যাকে বলা হয় ইভেন্ট হরাইজন। ইভেন্ট হরাইজনের ভেতরে কিছু প্রবেশ করলে তা আর বেরুতে পারে না বল ধারণ করা হয়। মোটা কথা ইভেন্ট হরাইজন বা ঘটনা দিগন্ত। এর পর আসলে কী ঘটে সেটা আমরা জানিনা বিধায়ই এমন নাম। এই সিঙ্গুলারিটি আর ইভেন্ট হরাইজন নিয়েই ব্ল্যাক হোল গঠিত।

একটি অ-ঘূর্ণন কৃষ্ণ বিবরের সাধারণ চিত্রণ।
একটি অ-ঘূর্ণন কৃষ্ণ বিবরের সাধারণ চিত্রণ।
Image Credit: Moheen Reeyad/Wikimedia Commons

এর মহাকর্ষ এত বেশি যে কিছুই এর মধ্য থেকে বের হতে পারে না, এমনকি আলোও নয়। তাই এটি আলো প্রতিফলিত করে না। এর বাইরের ইভেন্ট হরাইজনের চারপাশে যেখানে আলোকিত বস্তুসমূহ ঘুরতে থাকে সে জায়গাটিকে এক্রেশন ডিস্ক বলে। এক্রেশন ডিস্কের ঘূর্ণায়মান আলোকিত বস্তুসমূহ থেকেই ব্ল্যাক হোলকে চিহ্নিত করা যায়। এর ভেতরে ঢুকতে গেলে আপনার অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ব্ল্যাক হোল সাধারণত কয়েক ধরনের হয়:

স্টেলার ব্ল্যাক হোল: ছোটো আকৃতির ব্ল্যাক হোল।

ইন্টারমিডিয়েট মাস ব্ল্যাক হোল: মাঝারি আকৃতির ব্ল্যাক হোল।

একটি সক্রিয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল-এর একটি সিমুলেশন।Image Credit: NASA's Goddard Space Flight Center/Jeremy Schnittman
একটি সক্রিয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল-এর একটি সিমুলেশন।
Image Credit: NASA’s Goddard Space Flight Center/Jeremy Schnittman

সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল: এরা বিশালাকৃতির নক্ষত্রের পরবর্তী অবস্থা। দুই বা ততোধিক ব্ল্যাক হোল একত্র হয়েও গঠিত হতে পারে।

এই ছিল নক্ষত্রের জীবনচক্র ও মৃত্যু পরবর্তী অবস্থা। জীবনকালের চেয়ে মৃত্যু ও পরবর্তীকাল যেন বেশি আকর্ষণীয়। মৃত্যু হয়েও যেন মৃত্যু হয় না নক্ষত্রের। পুনর্জীবন লাভ করে কোটি কোটি বছর ধরে রাজত্ব করে চলে এই বিশাল মহাকাশে।

তথ্যসুত্র:
1. https://en.wikipedia.org/wiki/Star_formation
2. http://abyss.uoregon.edu/~js/ast122/lectures/lec13.html
3. https://en.wikipedia.org/wiki/White_dwarf
4. https://www.nasa.gov/mission_pages/GLAST/science/neutron_stars.html
5. https://www.nasa.gov/vision/universe/starsgalaxies/black_hole_description.html
6. https://en.wikipedia.org/wiki/Chandrasekhar_limit