“আমি আমার প্রিয়কে খুঁজছি আকাশে,
সেখানে কেন তুমি নেই?
মানুষের পেখমের শামিয়ানা
মাছরাঙার নীল পতাকা
নবম স্বর্গ থেকে নেমে এসো,
শান্ত করো ধূমকেতুকে।”
ধূমকেতু নামটি শুনলেই সবার প্রথমে আমাদের মনে আসে হ্যালির ধূমকেতুর কথা। ধূমকেতু, যার ইংরেজি নাম Comet, শব্দটি এসেছে গ্রিক comēta বা comētēs (κομήτης) শব্দ থেকে যার অর্থ চুলের জন্য। জায়ারেৎসাই নামক জাতির লোকেরা একে চুলতারাও বলে।
প্রাচীনকালে ধূমকেতু নিয়ে মানুষের মনে সবসময় একটা অজানা আতঙ্ক কাজ করত। প্রাচীন বিজ্ঞানী লি চুয়ান কেং (৬০২-৬৬৭ খ্রি.পূ.) ধূমকেতু সম্পর্কে বলেন, “ধূমকেতু একটি দুষ্ট নক্ষত্র। দক্ষিণ দিক থেকে যেসব ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটে তাদের কারণে পুরাতনদের পতন এবং নতুনদের উত্থান ঘটবে, তিমি মাছ মরতেই থাকবে। উত্তর দিক থেকে যেসব ধূমকেতু আসে তাদের কারণে রাজ্যের পরিবর্তন ঘটবে, বিদ্রোহ দেখা দেবে, যুদ্ধ চলবে। এটি বাটির আকার ধারণ করলে সোনা এবং রত্ন হয়ে যাবে মূল্যহীন।” বোঝা-ই যাচ্ছে প্রাচীন যুগের মানুষেরা ধূমকেতু নিয়ে কেমন ধারণা পোষণ করত।
ধূমকেতুর মূল বা প্রাথমিক কাঠামো হচ্ছে এর মাথাটা যা কিনা বরফের তৈরি। একে বলা হয় নিউক্লিয়াস। এদের প্রলম্বিত অংশ বা ধূলি-লেজে যেসব অতিক্ষুদ্র উপাদান থাকে সেগুলো হচ্ছে নিউক্লিয়াস থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা উপাদান। চার্জযুক্ত পরমাণুর এই লেজটি সৃষ্টি হয় যখন সূর্যের আলো অত্যুজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং নিউক্লিয়াসের গ্যাসীয় বস্তুগুলোর বাষ্পীভবন ঘটে। ধূমকেতুতে প্রায় ২৩ প্রকারের মৌল ও যৌগ রয়েছে। তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণে আছে কার্বন অথবা জৈব যৌগ এবং হাইড্রক্সিল পরমাণু (OH)।
ধূমকেতুর জন্মটাও খুব রহস্যজনক। সূর্যের প্রায় বিশ হাজার থেকে এক লক্ষ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট দূরে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগেকার সৌরজগৎ সৃষ্টির সময় ধূলি, গ্যাস, ইত্যাদি ধ্বংসাবশেষ সমবেত হয়ে দুই স্তর বিশিষ্ট বিশাল মেঘের সৃষ্টি করেছে। এই বিশাল ধূমকেতুময় মেঘের নাম ওর্ট (Oort) মেঘ। ডাচ জ্যোতির্বিদ জ্যান ওর্ট-এর নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে। এই ওর্ট মেঘের অঞ্চলই সৌরজগতের শেষ সীমানা। এখানে বরফপিণ্ডের মতো অনেক বস্তু গোলাকার কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান। কুইপার বেল্টে বৃহস্পতির মতো বড়ো কোনো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে বা ওর্ট মেঘের নিকটবর্তী কোনো নক্ষত্রের প্রভাবে কোনো বস্তু উপবৃত্তাকার কক্ষপথে সূর্যের দিকে এলে তবেই নতুন ধূমকেতুর জন্ম হবে।
ধূমকেতুর কি মৃত্যু হয়? -হ্যাঁ। ধূমকেতুর মৃত্যু হয়। মহাজাগতিক রশ্মির ফলে ওর্ট মেঘের অনুকূল পরিবেশে ধূমকেতুগুলো ক্রমাগত বিস্ফোরিত হতে থাকে, এর ফলে উচ্চগতির সংঘর্ষ হয় এবং ধূমকেতুর ক্ষয়সাধন হয়। ধূমকেতুর আয়ু প্রায় ১০,০০০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে ধূমকেতুগুলোর মাত্র ১০% ৫০ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারে এবং মাত্র ১% প্রায় ২,০০০ বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারে। এরপর ভেতরের উদ্বায়ী পদার্থ পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়। এছাড়াও সূর্যের অথবা বিভিন্ন গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ধূমকেতু সেই গ্রহে আছড়ে পড়ে এবং আত্মাহুতি দেয়।
ধূমকেতু নিয়ে যেসব বিজ্ঞানীরা মাথা ঘামিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন— ডেমোক্রিটাস, অ্যারিস্টটল, সেনেকা, অ্যাপোলোনিয়াস, টাইকো ব্রাহে, প্যারালাক্স এবং জোহানস কেপলার। তবে যাঁর সোনার কাঠির স্পর্শে ধূমকেতুবিদ্যা আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছিল, অবগুণ্ঠন মুক্ত হয়ে রহস্যের দুয়ার খুলে দিয়েছিল তিনি হলেন অ্যাডমন্ড হ্যালি। ছোটোবেলা থেকেই তাঁর জ্যোতির্বিদ্যার প্রতি আলাদা ঝোঁক ছিল। বাবা এডমন্ড তাঁর আগ্রহের কারণেই বেশ কিছু যন্ত্রপাতি কিনে দিয়েছিলেন। তার মধ্যে ছিল একটি টেলিস্কোপ।
তিনিই প্রথম জানালেন যে ধূমকেতুরও একটি উপবৃত্তাকার কক্ষপথ আছে। আর এটির প্রাণকেন্দ্র থাকে এই পথের ওপরেই। হ্যালি গ্রহের কক্ষপথের নানারকম হিসাব করার জন্য কৌণিক ছেদন নামে একটি নির্ভুল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। দক্ষিণ আকাশের মানচিত্র তৈরির জন্য দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পশ্চিম আফ্রিকার সেইন্ট হেলেনায়। ধূমকেতুর কক্ষপথ নিয়ে তাঁর আগে কোনো বিজ্ঞানীই তেমন একটা মাথা ঘামাননি। হ্যালি সেই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেন এবং ধূমকেতুর যাত্রাপথের নকশা বানান। হ্যালি ১৫৩১, ১৬০৭ এবং ১৬৮২ সালে আসা তিনটি ধূমকেতু নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন এবং আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে তিনটি ধূমকেতুর মধ্যে অসম্ভব মিল। তিনটি ধূমকেতু আসলে একই ধূমকেতু। পরে ধূমকেতুর কক্ষপথে রাশিচক্রের তলের ছেদবিন্দু দেখে তিনি এটা বুঝতে পারেন, যাকে কেতু বলে। সবকিছুই তিনটির ক্ষেত্রে মিলে গেল। কিন্তু গন্ডগোল বাঁধল এর আবির্ভাব হওয়ার সময় নিয়ে। ১৫৩১ থেকে ১৬০৭ সময় হচ্ছে ৭৬ বছর, আবার ১৬০৭ থেকে ১৬৮২ হচ্ছে ৭৫ বছর। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? এর জন্য তাঁকে ব্যাখ্যা দিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। নিউটন বললেন এরকম হচ্ছে কোনো গ্রহ বা ধূমকেতুর আকর্ষণ বলের প্রভাবে। যার ফলে ধূমকেতু তার পরিক্রমন পর্যায়ের এক সময় এক দিক থেকে কোনো বলের প্রভাবে পড়ে যাচ্ছে আবার ঠিক পরবর্তী সময়ে অন্যদিকের প্রভাব অনুভব করছে। এতে করে গতির পরিবর্তন হচ্ছে এবং আবির্ভাবের সময়ের হেরফের ঘটছে।
দেখতে পারব কি? ভাগ্য কি সহায় হবে?আবিষ্কৃত হয়ে গেল বিখ্যাত হ্যালির ধূমকেতু। এই ধূমকেতু সর্বশেষ দেখা গিয়েছে ১৯৮৬ সালে। একে আবার দেখা যাবে ২০৬২ সালের জুলাই মাসের কোনো এক দিনে। সেদিন আবার স্রষ্টার শনি তার পুচ্ছে আগুন ধরিয়ে নেমে আসবে নরকের দরজা হতে এবং অহংকার করে বলবে, “পুচ্ছে আমার কোটি নাগ-শিশু উদ্গারে বিষ-ফুৎকার।”
ভাবুন, ২০৬২ সালে মঙ্গল গ্রহে দাঁড়িয়ে আছে দুই জন মানুষ, হ্যালির ধূমকেতু দেখছে। তখন দূরের সাদাটে বিন্দুটি হবে আসলে মাটির পৃথিবী।
তথ্যসূত্র:
- The Nature of Comets by N. B. Richter
- মহাবিস্ময় ধূমকেতু : নাসরীন মুস্তাফা
- আকাশ চেনো : অরূপরতন ভট্টাচার্য
- Wikipedia
উত্তর দিন