বিষমতারা কী এবং কত প্রকার?

রাতের আকাশে মিটমিট করে জ্বলে তারা। পরিবর্তন হয় তাদের অনেকের ঔজ্জ্বল্যের। এরকম ঔজ্জ্বল্য পরিবর্তনকারী তারাগুলো কী, কেনই বা এদের ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তন হয়, এবং এরকম কত প্রকারের তারা আছে? সকল প্রশ্নর উত্তর জানতে পড়ে নিতে পারেন নিবন্ধটি।

অমাবস্যার পরিষ্কার রাতে আকাশে হাজার হাজার মিটমিট করে জ্বলা তারা অভূতপূর্ব মোহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। আপনি একটি খোলা মাঠে ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশে তাকালে দেখবেন ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি তারা, সারা আকাশ ভর্তি। সবগুলোই দেখতে একইরকম লাগে। কিন্তু আসলে তা না। ওখানে আছে কল্পনাতীত বৈচিত্র্য, হাজারো রহস্য! এখান থেকে যে তারকাগুলোকে এত ছোট্ট লাগছে তারা আসলে অনেক বড়ো বড়ো! যাদের দেখতে হুবহু একরকম লাগছে, সেগুলোই একটা আরেকটা থেকে কত আলাদা! কত বিচিত্র!

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা লক্ষ লক্ষ বিষমতারা সম্পর্কে জানেন। আপনি আকাশের যে কোনও অংশেই এই বিষমতারা খুঁজে পেতে পারেন। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির মধ্য অঞ্চলের এই চিত্রের তারাগুলির মধ্যে ২টি পরিচিত সেফালি বিষমতারা রয়েছে। তারা অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন কারণে পরিবর্তিত হয়। ক্রেডিট: ESO/ VVV consortium/ D. Minniti.

তারাগুলো দেখলে মনে হয় এরা একইভাবে জ্বলছে তো জ্বলছেই কিন্তু বেশিরভাগ তারাই আসলে একইভাবে জ্বলতে থাকে না। এদের ঔজ্জ্বল্যের পরিবর্তন হয়। এই তারাগুলোকে বলা হয় বিষমতারা।

বিষমতারার উজ্জ্বলতা সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়। কোনোটা নিয়মিত, কোনোটা প্রায় নিয়মিত, কোনোটা অনিয়মিত। কোনো তারা হঠাৎ করেই অনেকখানি উজ্জ্বল হয়ে যায়, কোনোটা কয়েক ঘন্টা, কয়েক দিন বা মাস ধরেও ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে পারে। আবার কোনোটা ঘড়ির কাটা ধরে চেইঞ্জ হয়, কোনোটা কোনো নিয়ম-নীতির থোরাই কেয়ার করে। উজ্জ্বলতার এই পরিবর্তন কিন্তু বায়ুমণ্ডল বা আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। তারাদের অভ্যন্তরীণ কারণে তাদের উজ্জ্বলতার চেইঞ্জ হয়।

বিষমতারাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
১. প্রকৃত বিষমতারা, এবং
২. অপ্রকৃত বিষমতারা।

প্রকৃত বিষমতারা হলো যেগুলো আসলেই বিষমতারা, মানে ভেজাল নেই। যদি ভেজাল থাকে, তাহলে সেগুলো হলো অপ্রকৃত। কী ভাবছেন? এখানেও ভেজাল! কীভাবে সম্ভব?

শিল্পীর ছাপে বায়নারি স্টার সিস্টেম বা জোড়া তারার গ্রহণ। ক্রেডিট: ESO/L. Calçada

আসলে সম্ভব। জোড়া তারা বা যুগ্ন তারা (Binary star) আছে না? জোড়া তারাগুলো একটা আরেকটাকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। ধরুন, ঘুরতে ঘুরতে দুইটা তারা পাশাপাশি চলে এসেছে, যেহেতু তারা দুটো খুব কাছাকাছি অবস্থিত। তাই পৃথিবী থেকে তাদের আলাদা করে বোঝা যাবে না, একটা উজ্জ্বল তারা মনে হবে। আবার ঘুরতে ঘুরতে একটা আরেকটার পিছনে চলে গেল, তখন গ্রহণের মতো ব্যাপার হয়। তখন তাদের উজ্জ্বলতা অনেক কমে গেছে মনে হবে। আসলে কিন্তু কোনো তারার উজ্জ্বলতার কম-বেশি হয়নি, কিন্তু মনে হয় হয়েছে। এইখানেই হলো ভেজাল।

এখন তাহলে প্রকৃত বিষমতারাগুলোর রকমফের একটু দেখি চলুন।

প্রকৃত বিষমতারা প্রধানত দুই প্রকার —

১. স্পন্দিত বিষমতারা, এবং
২. বিস্ফোরক বিষমতারা।

‘স্পন্দিত তারা’ নাম শুনেই বুঝতে পারছেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে এগুলোর ঔজ্জ্বল্য হ্রাস ও বৃদ্ধি পায়, স্পন্দনের মতো এবং প্রতিবার এই হ্রাস-বৃদ্ধির সময়কাল একইরকম থাকে।

তারার উজ্জ্বলতায় পরিবর্তিত হয়েছে (তবে নিয়মিত নাও হতে পারে) এমন উদাহরণ। নাম, বেটেলজিউস (Betelgeuse)। এই তুলনা ছবিটি তার নজিরবিহীন ম্লানির আগে ও পরের চিত্র দেখায়। এই ২টি চিত্র দেখায় যে তারকাটি কতটা বিবর্ণ হয়েছিল এবং কীভাবে এর আপাত আকৃতি পরিবর্তন হয়েছিল। এখন আবার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় ফিরে এসেছে।
ক্রেডিট: ESO/ M. Montargès, গং

বেশ কয়েক ধরনের স্পন্দিত বিষমতারা আছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো শেফালি (Cephied) জাতীয় বিষমতারা। এই তারাগুলো বিশাল–দানবাকৃতির। সূর্যের চেয়ে এরা প্রায় ৫০০ থেকে ৩,০০,০০০ গুণ বড়ো হয়ে থাকে। আর এদের উজ্জ্বলতা খুব কম সময়ের মাঝে চেইঞ্জ হয়। মাত্র ১ থেকে ১০০ দিনের মাঝে।

এরকম শর্ট পালসেটিং পিরিয়ড কিন্তু একটু ছোটো সাইজের পুরানো তারা নিয়ে আছে – আর আর লেয়রি (RR Lyrae) তারা।

আরভি টাউরি (RV Tauri) টাইপ তারাও স্পন্দিত তারা, এরা সাইজে অনেক বড়ো হয় এবং এদের আলোর অনেক ভেরিয়েশন আছে।

আরেক ধরনের তারা আছে যাদের স্পন্দনের পর্যায়কাল অনেক দীর্ঘ। এই লং পিরিয়ড ভেরিয়েবলসের মাঝে আছে দুই ধরনের তারা। একটা হলো মিরা, এরা রেড সুপারজায়ান্ট, বিশাল সাইজের কিন্তু তাপমাত্রা কম। এদের দীর্ঘ সময় নিয়ে উজ্জ্বলতার অনেক চেইঞ্জ হয়।

আর আছে সেমিইরেগুলার। এরা হলো
মিডল বেঞ্চারদের মতো, যতই ট্রাই করুক টাইমলি সব শেষ করবে কিন্তু শেষমেশ পুরোপুরি আর হয় না। এরা সুপারজায়ান্ট বা রেড জায়ান্ট হয় এবং এদের পিরিয়ড রেইঞ্জ ৩০ থেকে ১,০০০ দিনের হয়ে থাকে।

বিস্ফোরক (Eruptive বা Cataclysmic) তারার কাজ-কারবারও নাম শুনেই বোঝা যায়। ওই যে দুড়ুম দুড়ুম করে অনুজ্জ্বল একটা তারাকে মুহূর্তে উজ্জ্বল করে ফেলে!

অনিয়মিত বিরতিতে বিস্ফোরক বিষমতারা উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরণের বিস্ফোরক বিষমতারা বিদ্যমান। ছবিতে একটি সাদা বামন নক্ষত্র বৃহত্তর একটি তারা প্রদক্ষিণ করছে, যা থেকে বস্তু সাদা বামনের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। সাদা বামনের পৃষ্ঠে যখন যথেষ্ট বস্তু পরিমাণ জমে থাকে, তখন একটি ফিউশন ফেটে পড়ার কারণে তারাটি মূলত আলোকিত হয়। আগত বস্তু (হাইড্রোজেন) একবার হিলিয়ামে পরিণত হয়ে গেলে, নক্ষত্রটি পরবর্তী চক্র পর্যন্ত আবার ম্লান হয়ে যায়।
ক্রেডিট: David Hardy/ PPARC/ APOD

হ্যাঁ, তাই আসলে। এই তারাগুলোর উজ্জ্বলতা খুব কম সময়ের মাঝে অনেক চেইঞ্জ হয়।

উদাহরণ হিসেবে আছে আমাদের প্রিয় সুপারনোভা।

কোনো তারার ভর যথেষ্ট বেশি হলে জীবনের শেষ দিকে যখন লোহা সংশ্লেষণও শেষ হয়ে যায়, তখন নিজের প্রচণ্ড ভর সহ্য করতে না পেরে এক অতি ভয়ংকর মহাজাগতিক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে তারাটা ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন স্টারে পরিণত হয়। আর তখন এর উজ্জ্বলতা একশ মিলিয়ন গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

আরও আছে নোভা, রিকারেন্ট নোভা। কোনো ক্লোজ বাইনারি সিস্টেমে শ্বেত বামনে যদি একবার বিস্ফোরণ হয় তবে তাকে ক্লাসিক্যাল নোভা বলে। আর কোনো কোনো শ্বেত বামনে যদি বার বার এমন বিস্ফোরণ হয়, তাহলে তাকে রিকারেন্ট নোভা বলে। এদের ঔজ্জ্বল্য হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পায়। মূলত এদের সার্ফেসে ঘটা বিস্ফোরণের কারণে এমন হয়। আর এদের উজ্জ্বল অবস্থার স্থায়িত্বও কম হয়।

আর হ্যাঁ, আপনি কি জানেন আমাদের সূর্যও একটা বিষমতারা?

সুত্র: space.com, earthsky.org