মহাবিপন্ন রাজ শকুন

প্রকৃতির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে শকুন একটি পরিচিত পাখি। নানা ধরনের মরা-পচা খেয়ে রোগ-জীবাণুর হাত থেকে যেমন আমাদের রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতেও সাহায্য করে। বর্তমানে এই উপকারী পাখিটি; বিশেষ করে এই প্রজাতিন রাজ শকুন মানুষের অবহেলা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা আর অদূরদর্শিতার কারণে অতিবিপন্ন প্রাণীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

‘শকুন’ শব্দটি শুনলে চোখে ভেসে উঠে কিছু ভয়ংকরদর্শন পাখির ছবি। তীক্ষ্ণ ঠোঁটে মাংস খুবলে খাওয়ার দৃশ্য। কারো-কারো চোখে সে দৃশ্য রীতিমত বীভৎস মনে হয়। মানুষ তাদেরকে অপয়া, অশুভ প্রতীক ইত্যাদি অপবাদ দিয়েছে। তবে প্রকৃতি জানে, এরা প্রকৃতির কেমন গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কোনো প্রাণীর মৃতদেহ কোথাও পড়ে থাকলেই কোথা থেকে যেন হাজির হয় এরা। দলবেঁধে দ্রুত সাবাড় করে মৃতদেহ।

প্রাকৃতিক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর দায়িত্ব পালন করা এই শকুনদের এখন আর সহজে দেখা যায় না। ক্রমাগত বন উজাড় ও গাছপালা কর্তনের ফলে উপকারী পাখিগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। সমগ্র বিশ্বেই শকুন বর্তমানে বিপন্ন প্রাণী, তন্মধ্যে কিছু প্রজাতি মহাবিপন্নের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। রাজ শকুন তাদের মধ্যে অন্যতম।
পৃথিবীতে সর্বমোট ২৩টি আলাদা প্রজাতির শকুন দেখা যায় যাদের মধ্যে Bangladesh Vulture Conservation Action Plan, ICUN এর হিসেব মতে বাংলাদেশে ৭টি প্রজাতির শকুন রয়েছে। রাজ শকুন এর মধ্যে একটি মহাবিপন্ন প্রজাতি।

রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Chungba Sherpa
© Nepal Important Bird Records
📍 Jatayu (Vulture Restaurant), Nawalparasi, Pashchimanchal, Nepal
🗓️ 6 Sep 2020

International Union for Conservation of Nature বা IUCN কর্তৃক তৈরি করা Red list এ এদেরকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ১৯৭৪ এবং ২০১২ এর তফসিল ১ অনুযায়ী বাংলাদেশে মহাবিপন্ন ও সংরক্ষিত প্রাণীর তালিকায় রয়েছে এরা। একসময় পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রাজ শকুনের দেখা মিলত। এখন আর এদের দেখা পাওয়া যায় না। আমাদের দেশ থেকে এরা প্রায় বিলুপ্তই বলা চলে।

শ্রেণিবিন্যাস:
বাংলা নাম: রাজ শকুন
ইংরেজি নাম: Red-headed Vulture
বৈজ্ঞানিক নাম: Sarcogyps calvus
জগৎ: Animalia
পর্ব: Chordata
শ্রেণি: Aves
বর্গ: Accipitriformes
পরিবার: Accipitridae
গণ: Sarcogyps
প্রজাতি : S. calvus

রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Markus Lilje
📍 Jim Corbett National Park, Garhwal, Uttarakhand, India

অন্যান্য শকুনের তুলনায় রাজ শকুনের বর্ণ ও গড়নে চোখে পড়ার মত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এদের চিহ্নিত করা খুব কঠিন নয়। দেখতে বড়ো আকৃতির এই শকুনের দেহের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৭৬-৮৬ সেন্টিমিটার এবং প্রসারিত ডানার দৈর্ঘ্য প্রায় ১৯৯-২৬০ সেন্টিমিটারের মতো হয়। এদের ন্যাড়া মাথায় সুস্পষ্টভাবে লাল বা কমলা রং দৃশ্যমান। গলা ও ঘাড় কুঁচকানো লাল চামড়ায় আবৃত থাকে। চামড়ার উপর ছোট কালো পশম রয়েছে। বুকে সাদা পালক দিয়ে ঢাকা, পিঠ কালচে, ডানা ও লেজ বাদামি কালো রঙের এবং পা ম্লান গোলাপি বর্ণের হয়ে থাকে। পুরুষ শকুনের চোখ কিছুটা সাদা এবং স্ত্রী শকুনের চোখ বাদামি রঙের হয়। বাঁকানো ঠোঁটে গোলাপি আভা দেখা যায়। অন্যান্য শকুনের তুলনায় এরা দেখতে অনেকটা সুন্দর এবং সহজেই তাদের চেনা যায়।

রাজ শকুন প্রধানত শবভোজী। যে-কোনো প্রজাতির প্রাণীর মৃতদেহ ভক্ষণ করে তারা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিশক্তি রয়েছে তাদের। সাধারণত মাটি হতে ২৫০ থেকে ৩০০ মিটার উপরে বিচরণ করে এরা। এত উপরে থেকেও তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ফলে সহজে যে-কোনো প্রাণীর মৃতদেহের সন্ধান পেয়ে যায়। দলবেঁধে ছুটে আসে মৃতদেহ ভোজনে। এছাড়া শামুক, পাখির ডিমসহ নানা সরীসৃপও এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে।

দেখতে ভয়ংকর মনে হলেও পাখিগুলো খুবই নিরীহ। চুপচাপ ভোজন সেরে চলে যায়। উচুঁ গাছের ডালে সরু কাঠি দিয়ে বাসা বাঁধে তারা। সাধারণত একটিই ডিম পাড়ে এবং মাস দুয়েকের মধ্যে ডিম ফুটে ফুটফুটে বাচ্চা বের হয়। প্রাপ্তবয়স্করা দলবেঁধে আকাশে বিচরণ করে, খাওয়ার সময়ও একত্রে খাবার খায়।

বিরল প্রজাতির এই শকুনগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়েছে। অন্যান্য প্রজাতির শকুনদেরও এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। ২০১৭ সালে IUCN এবং বাংলাদেশ বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে করা এক সমীক্ষা হিসেবে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির শকুনের সংখ্য মাত্র ২৬০টি।

বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ ও খাদ্যের অভাবে শকুনেরা বিলুপ্তির খাতায় নাম লিখিয়েছে। ‘ডাইক্লোফেন‘ নামের ব্যথানাশক ঔষধের প্রভাবে শকুন কিডনি বিকল হওয়ার কারণ মারা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১০ সালে ডাইক্লোফেন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। এছাড়া শকুন প্রজাতিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে এবছর অর্থাৎ ২০২১ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে কেটোপ্রোফেন নিষিদ্ধ করেছে। তবে এদেশে হয়তো আর কখনও মিলবে না রাজ শকুনের দেখা।

 

গ্যালারি:

রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Lars Petersson
📍 Corbett NP, Nainital, Uttarakhand, India
🗓️ 6 Jan 2016
রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Mayur Patel
📍 Gir Wildlife Sanctuary–General, Junagadh, Gujarat, India
🗓️ 28 Dec 2018
উড়ন্ত রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Ayuwat Jearwattanakanok
📍 Western Siem Pang Wildlife Sanctuary, Stueng Traeng [Stœng Trêng], Cambodia
🗓️ 22 Mar 2017
উড়ন্ত রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Rohit Sharma
📍 Ranthambore NP, Sawai Madhopur, Rajasthan, India
🗓️ 26 Sep 2017
রাজ শকুন (Sarcogyps calvus)
📸 Rajubhai Patel
📍 Gir Wildlife Sanctuary–General, Junagadh, Gujarat, India
🗓️ 18 May 2019
একদল রাজ শকুন (Sarcogyps calvus) মৃতদেহ ভক্ষণ করছে
📸 Jordi Sargatal
📍 Veal Krous, Preah Vihéar, Cambodia
🗓️ 10 Mar 2011

তথ্যসূত্র: