কেন কেউ তার পরিবারের সদস্যদের থেকে রক্ত নিতে পারবে না?

সমসাময়িক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “আপনার আত্নীয় ডোনার হবে না” শীর্ষক একটি ঘোষণা নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়। এখন প্রশ্ন থাকতে পারেন যে, কেন কেউ তার পরিবারের সদস্যদের থেকে রক্ত নিতে পারে না? প্রশ্নটির যথাযথ উত্তর পেতে নিবন্ধটি পড়ে ফেলুন।

রক্তদান সম্পর্কে এটা অনেক জিজ্ঞাসিত ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। ছোটো করে উত্তর শুনতে হলে বলা যায় — আপনজন; বিশেষ করে কাছের আপনজন (মা, বাবা, ভাই, বোন, ছেলে, মেয়ে ইত্যাদি) থেকে রক্ত নিলে transfusion-associated graft versus host disease (TA-GvHD) ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। প্রক্রিয়াটি একটু জটিল কিন্তু এটাকে সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা যাক।

যখন আপনি কোনো অপরিচিত যথেচ্ছ ডোনার থেকে এক প্যাকেট রক্ত নেন, তখন আসলে আপনি যা নেন তা হচ্ছে প্যাকেট ভর্তি লোহিত রক্তকণিকা। তখন প্লাজমা, শ্বেত রক্তকণিকা, অণুচক্রিকা সরিয়ে ফেলা হয় যতটা পারা যায়। একেবারে নিখুঁত করা যায় না, কিছু পরিমাণ লোহিত রক্তকণিকা আর প্লেইটলেট প্যাকেটে থেকেই যায়। এগুলো রক্তগৃহীতার জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা মাঝে মাঝে জীবন বিপন্নের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই ঝুঁকিগুলোর একটা অংশ আসে ডোনারের শ্বেত রক্তকণিকা থেকে। নির্দিষ্ট করে বললে T-cells থেকে।

T-cell হচ্ছে আমাদের প্রতিরক্ষা সিস্টেমের বস। T-lymphocyte এর অপর নাম। এইটা দেহের লাস্ট লাইন ডিফেন্স সিস্টেম বা টি-সেল, সবচাইতে শক্তিশালী প্রতিরোধ সিস্টেম। এরা বোঝে কোন কোষটা আমাদের দেহের ভিতরের, আর কোনটা দেহের বাইরের। যখন আমাদের দেহের বাইরে থেকে রক্ত আসে, তখন ডোনারের দেওয়া রক্তে থাকা T-cell -গুলো রোগীর দেহে এসে তার দেহের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করবে, কারণ সেটা তো তার কাছে অচেনা।

টি-সেল একটি ক্যান্সারের কোষে আক্রমণ করছে।
ক্রেডিট: Andrea Danti/Shutterstock

এখন দেখা যাচ্ছে, আপনার অর্ধে একটা অ্যাটাকার ঢুকে গেছে। ডিফেন্ডার হিসেবে আপনি যদি তাকে না আটকান কী হবে? ফাঁকতালে গোল দিয়ে আসবে! ঠিক এভাবেই যখন ডোনারের রক্ত থেকে আসা T-cell গুলোকে না আটকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে তারা তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করে আপনার দেহের T-cell গুলোকে ধ্বংস করে দেবে। এটাকে ‘Graft versus host effect‘ বলা হয়। এখানে graft হচ্ছে ডোনারের দেওয়া রক্ত, আর host হচ্ছে রোগী। যখন রক্ত সঞ্চালনের সময় এটা হয় তখন এটাকে আর এই নামে না ডেকে transfusion-associated graft versus host disease (TA-GvHD) নামে ডাকা হয়।

এর ফলে আমাদের দেহের ডিফেন্সে ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে যেমন কেমোথেরাপি বা অন্য কোনো চিকিৎসা বা রোগ থাকলে রক্ত নেওয়া ভেজাল হবে, কারণ তখন ডিফেন্স সিস্টেম এমনিতেই দুর্বল থাকে। আর ডোনারের রক্তের টি-সেল এই সুযোগটা কাজে লাগায়। একবার ডোনারের টি লিম্ফোসাইট জিতে গেলে খেল খতম। TA-GvHD-তে ভুগতে হবে। কোনো সেকেন্ড লেগ মানে রিকভারের অপশন নেই।

এখন দেখেন, যিনি রক্ত নিবেন, তারও দেহে তো T-cell আছে এবং তার দেহে T-cell এর সংখ্যা ডোনারের রক্তের সাথে আসা T-cell এর থেকে অনেক অনেক বেশি। সে তো আর অ্যাটাকারকে ফেলে রাখবে না! (ম্যাগুয়ের টাইপ ডিফেন্ডার না হলে!) সে কী করবে? অ্যাটাকারকে তার ডিফেন্স দিয়ে ধরে অকার্যকর করে ফেলবে।

একটা সাধারণ প্রশ্ন, মাঠে ২২টা প্লেয়ার থাকে, ২ ভাগে ভাগ করে কী দিয়ে? জার্সি দিয়ে? এখন মনে করেন আপনার অ্যাটাকার আপনার হাফে আপনার জার্সি নিয়ে ঘুরছে। আপনি কি তাকে অ্যাটাকার ভাববেন? অবশ্যই না!

এটা হবে যখন আমরা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেটিভের কাছ থেকে রক্ত নেব। তাদের রক্তের আর আমাদের রক্তের গঠন তো প্রায় একই। ফলে আপনার ডিফেন্ডার, মানে আপনার দেহের T-cell বিপরীত পক্ষের অ্যাটাকার অর্থাৎ, ডোনারের T-cell কে চিনতে পারবে না। চিনতে না পারলে আটকানোর প্রশ্নই আসে? বিষয়টা এমন হবে আপনার দলের জার্সি পড়ে বিপক্ষ দলের অ্যাটাকার আপনার হাফে আর আপনার ডিফেন্ডার কিছু করার আগেই বিপক্ষ দলের গোল! অর্থাৎ (TA-GvHD) হয়ে যাবে!

তো কথা হচ্ছে আমরা কি এটা আটকাতে পারি না? অবশ্যই পারব! কেন না? দেখেন ঘটনার মূল কোথায়? ফুটবল মাঠে আপনার হাফে অ্যাটাকার না আসলে গোল হবে? তাই আমরা যে প্যাকেট থেকে রক্ত নিচ্ছি তা ২৫ Gy গামা বিকিরণ দিয়ে দিলে আর ঝুঁকি থাকছে না।

এখন অনেকে বলবেন, আমরা তো পরিচিতজনের মধ্যে রক্ত দিই কিন্তু কোনো সমস্যা হয় না। কেন হয় না? দেখেন, সবসময় তো এমন না যে আপনার ডিফেন্স ডোনারের টি-সেলকে চিনতে পারবে না! চিনবে কিন্তু কিছু মাঝে মাঝে মিস হওয়ার চান্স থাকে। আর ক্যান্সার বা এইডস বা দেহের প্রতিরক্ষা সিস্টেম দুর্বল থাকলে তো নিজেদের মধ্যে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। র‍্যান্ডম ডোনার থেকে নেওয়াই ভালো। তবে অবশ্যই ক্রস চেক করে নিতে হবে।

রেফারেন্স:

TA-GVHD, a Fatal Complication Following Blood Transfusion from a First-Degree Relative, The Journal of Obstetrics and Gynecology of India (2012-13)

https://doi.org/10.1007/s13224-012-0189-x