আজকে আলোচনা করবো বিড়াল (Felis domesticus) -এর রসায়ন নিয়ে। মূলত তিনটি বিষয়ের দিকে নজর দেয়া হবে আজকে; কেন বিড়ালে কিছু মানুষের অ্যালার্জি থাকে, কেন বিড়ালের মূত্র দুর্গন্ধযুক্ত হয়, কেন বিড়াল ক্যাটনিপ (catnip, বৈজ্ঞানিক নাম: Nepeta cataria) গাছের পাতা পছন্দ করে। অর্থাৎ,
যেসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রবন্ধটি পড়া শেষে তা হলো:
১। কেন বিড়ালে কিছু মানুষের অ্যালার্জি থাকে?
২। কেন বিড়ালের মূত্র দুর্গন্ধযুক্ত হয়?
৩। কেন বিড়াল ক্যাটনিপ (catnip) গাছের পাতা পছন্দ করে?
বিড়ালের ওপর পর্যবেক্ষণ করলে কিছু বিষয় লক্ষ করতে পারবেন।
১। বিড়ালে আসলেই কিছু মানুষের অ্যালার্জি আছে।
২। বিড়ালের মূত্র আসলেই দুর্গন্ধ হয়ে যায় কিছুক্ষণ পরেই, বিশেষ করে কোনো সলিড ফ্লোর (যেমন টাইলসকৃত কিংবা মোজাইককৃত)-এর ওপর যেখানে শোষিত হয় না।
৩। বিড়াল আসলেই ক্যাটনিপ (catnip) খুবই পছন্দ করে। বাজারে ক্যাটনিপের পাতা বয়াম আকারে কিনতে পাওয় যায়। গবেষণা হিসেবে প্রায় ৬০–৭০ শতাংশ বিড়ালই মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখায় ক্যাটনিপের এর বিপরীতে।
একটা মজার ব্যাপার হলো বিড়ালের বিভিন্ন কাজের জন্য দায়ী রাসায়নিকের নামও (২টি) বিড়ালের নামে নামকরণ করা হয়েছে।
বিড়ালে অ্যালার্জি
আপনার যদি বিড়ালে অ্যালার্জি থাকে তাহলে আপনি একা নন। বিভিন্ন দেশের জরিপে দেখা গেছে যে, সাধারণ জনসংখ্যার ১০ থেকে ৩০ শতাংশের বিড়ালে অ্যালার্জি থাকে। World Health Organisation (WHO) এর তথ্য মতে, ৮ ধরনের অ্যালার্জি শনাক্ত করা গেছে যেগুলোর জন্য বিড়াল দায়ী। আর এদেরকে Fel d 1 থেকে Fel d 8 হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। Fel d হলো ল্যাটিন শব্দ (এটিই আবার গৃহপালিত বিড়ালের বৈজ্ঞানিক নাম) ‘Felis domesticus’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ যার ইংরেজি অর্থ ‘domestic cat’ বা বাংলাতে ‘পোষা বিড়াল’।
এই ৮ ধরনের বিড়াল অ্যালার্জির মধ্যে Fed d 1 হলো প্রাথমিক পর্যায়ের এবং সবচেয়ে বেশি কমন অ্যালার্জি। ৬০ থেকে ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রেই এটি দেখা যায়। Fed d 1 বিড়ালের ত্বকে তেল উৎপাদনকারী গ্রন্থি দ্বারা উৎপাদিত একটি সিক্রেটোগ্লোবিন (Secretoglobin বা SGCB হলো এক ধরনের ছোটো, alpha-helical, disulfide linked, dimeric প্রোটিন) প্রোটিন থাকে। এই প্রোটিন তাদের চামড়া, পশম এবং লালায় পাওয়া যায়, যদিও এর সঠিক জৈবিক ফাংশন এখনো অজানা।
বিড়ালের মৃত চামড়া যেগুলো ক্ষুদ্রাতিক ক্ষুদ্র পর্যায়ের সেগুলো বিড়ালের হাঁটাচলার মাধ্যমে খুব সহজেই আশেপাশে ছড়ায়। এর ফলে বিড়াল যেখানেই যাক না কেন Fel d 1 খুব সহজেই ছড়াতে পারে। আর ছড়ানোর সময় খুব ভালোমতোই ছড়ায়। আমেরিকার বাড়িগুলোতে এক জরিপে দেখা গেছে যে ৯৯% বাড়িতেই Fel d 1 এর সন্ধান মিলেছে।
Fel d 1 নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নিলে অ্যালার্জির সমস্যা শুরু হয়। মূলত যাদের অ্যালার্জি আছে তাদের দেহ নিঃশ্বাসের মাধ্যমে Fel d 1 শরীরে প্রবেশ করলে তাদের শরীর একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠিয়ে দেয়। এতে Fel d 1 এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই অ্যান্টিবডি মাস্ট কোষ [Mast cell: মাস্ট কোষ (mastocyte বা এক ধরনের labrocyte নামেও ডাকা হয়) হলো আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য এক ধরনের টিস্যু কোষ।] থেকে হিস্টামিন (histamine) রিলিজ করে। যার ফলস্বরূপ হাঁচি সহ বিভিন্ন অ্যালার্জির লক্ষণ তৈরি হয়।
পুরুষ বিড়াল মেয়ে বিড়াল থেকে বেশি Fel d 1 উৎপন্ন করে। আবার নিউটারড পুরুষ বিড়াল (অণ্ডকোষ কেটে ফেলা পুরুষ বিড়াল) মেয়ে বিড়ালের তুলনায় কিছু মাত্রায় কম উৎপাদন করে। কিন্তু যতই কম উৎপন্ন করুন না কেন, সেটা অ্যালার্জির লক্ষণ প্রকাশের জন্য পর্যাপ্ত। তো এখানে সেটা যুক্তিসঙ্গতভাবে খুব একটা পার্থক্য গড়ে দেয় না। যদিও প্রায়শই বলা হয়ে থাকে যে বিড়ালের কয়েকটি প্রজাতি কম Fel d 1 তৈরি করতে পারে, কিন্তু এ কথার সঙ্গে শক্ত কোনো প্রমাণ নেই।
বিড়ালের মূত্রের দুর্গন্ধ
Fel d 1-8 নাকের মধ্যে প্রবেশ করলে কোনো গন্ধ না পেলেও বিড়ালের মূত্রের ক্ষেত্রে ঠিকই দুর্গন্ধ রয়েছে। আর এটির জন্যও সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক ব্যাখ্যা বিদ্যমান। বিড়ালের তাজা মূত্র বা সদ্য বিসর্জন দিয়েছে এমত অবস্থায় আসলে তেমন গন্ধ নেই। কিন্তু সেটা তো আর বেশি সময় তাজা থাকে না। ব্যাকটেরিয়ারা তো আর তাদের কাজ থামিয়ে রাখে না। তো ব্যাকটেরিয়া সেই মূত্রের রাসায়নিক উপাদানগুলি ভেঙে সেই দুর্গন্ধযুক্ত যৌগগুলি উৎপন্ন করে।
এই দুর্গন্ধের চাবিকাঠি হলো বিড়ালের মূত্রে পাওয়া একটি বিশেষ অ্যামিনো অ্যাসিড, যার নাম ফেলিনিন (felinine), IUPAC নাম: (2R)-2-Amino-3-(3-hydroxy-1,1-dimethylpropyl)thiopropanoic acid।
তারপর এনজাইম ফেলিনিনকে ভেঙে ফেলে, ভাঙনে অ্যামোনিয়া, কার্বন ডাইঅক্সাইড এবং MMB (3-methyl-3-sulfanylbutan-1-ol) উৎপন্ন হয়। অ্যামোনিয়া তো তীব্র গন্ধ থাকার জন্য বিখ্যাত সেটা আমরা জানি, কিন্তু সালফার বহনকারী যৌগ অর্থাৎ, MMB বিড়ালের মূত্রের দুর্গন্ধের জন্য বড়ো ভূমিকা পালন করে।
ফেলিনিন শুধু একা ভূমিকা পালন করে না। বিড়ালের মূত্রে 4-methyl-4-sulfanylpentan-2-one নামের আরেকটি যৌগ পাওয়া যায়, যেটাও অনেক ক্ষেত্রে দায়ী। যৌগটিকে সাধারণত ‘cat ketone’ নামে সম্বোধন করা হয়। তবে বিড়ালের মূত্র ছাড়াও এ যৌগটি অন্য জায়গায় পাওয়া যায়।
এখন একটা ট্রিক বলি, যদি আপনার বাসাতে পোষা বিড়াল থাকে এবং সেটা যদি যেখানে-সেখানে মূত্র বিসর্জন করে তাহলে enzyme-based cleaner ব্যবহার করতে পারেন। এতে গন্ধও দূর হবে আর বিড়াল ওখানে আর যাবে না মূত্র বিসর্জন দিতে।
ক্যাটনিপের প্রতি বিড়ালের প্রতিক্রিয়ার কারণ
এখন কথা বলা যাক, কেন বিড়াল ক্যাটনিপ (catnip) খুব পছন্দ করে। এটা আসলে বড়ো একটা আলোচনার বিষয়, এটা নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে গবে। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে নেপিটাল্যাকটোন (nepetalactone) নামের একটি যৌগ ক্যাটনিপে পাওয়া যায়, যেটি বিড়ালের ওপর এরকম অদ্ভুত প্রভাবের কারণ ঘটায়। মূলত যৌগটি নাসিকার (nasal tissue) রিসেপ্টরের সাথে যুক্ত হয়ে মস্তিষ্কে এমন একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে যা প্রাকৃতিক সেক্স ফেরোমোনের জন্য তৈরি প্রতিক্রিয়ার সদৃশ্য। Olfactory fatigue বা noseblindness অবস্থা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করে।
তো সে হিসেবে ক্যাটনিপের প্রতিক্রিয়া মাত্র ১০-১৫ মিনিট সময়টুকুই থাকে, যেহেতু ১০-১৫ মিনিট পরেই olfactory fatigue অবস্থা তৈরি হয়। আর ক্যাটনিপ ৭০ শতাংশ বিড়ালের ওপর কার্যকরী প্রভাব ফেলতে পারে। আর ছোটো বিড়ালের বাচ্চাদের ওপর প্রভাব ফেলে না যেহেতু তাদের মস্তিষ্ক সেক্স ফেরোমোনের প্রতিক্রিয়া তখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি।
ক্যাটনিপই কিন্তু একমাত্র উদ্ভিদ না যেটা বিড়ালদের খুব পছন্দ। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এমন আরও অনেক রয়েছে যার ফলে একই প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। এর মধ্যে Valerian (Valeriana officinalis) নামক গুল্মের শিকড় এবং পাতা, Silver vine (Actinidia polygama; যাকে cat powder-ও বলা হয়) এবং tatarian honeysuckle অন্যতম। এ সকল উদ্ভিদে নেপিটাল্যাকটোন (nepetalactone) যৌগের উপস্থিতি নেই, তবে অ্যাক্টিনিডিনের (actinidine; IUPAC নাম: (7S)-4,7-Dimethyl-6,7-dihydro-5H-cyclopenta[c]pyridine) অনুরূপ অণু রয়েছে যা একই ধরনের প্রভাব তৈরি করে।
নেপিটাল্যাকটোন (nepetalactone) কিন্তু শুধু গৃহপালিত বিড়াল ওপর প্রভাব ফেলা না, সিংহ, বাঘ এবং চিতাবাঘের উপরও প্রভাব ফেলে। ক্যাটনিপ মশা তাড়ানোর কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে এটি মানুষকে বিড়ালের মতো একইভাবে প্রভাবিত করে না, কারণ মানুষের মস্তিষ্ক বিড়ালের থেকে শারীরবৃত্তীয়ভাবে আলাদা।
তথ্যসূত্র এবং বিস্তারিত:
- Standard skin prick testing and sensitization to inhalant allergens across Europe – a survey from the GA²LEN network*. DOI: 10.1111/j.1398-9995.2005.00895.x
- An update on molecular cat allergens: Fel d 1 and what else? Chapter 1: Fel d 1, the major cat allergen. Allergy Asthma Clin Immunol 14, 14 (2018). DOI: 10.1186/s13223-018-0239-8
- No Epidemiological Evidence for Infant Vaccination to Cause Allergic Disease. DOI: 10.1542/peds.2005-0698N
- Allergens as Immunomodulatory Proteins: The Cat Dander Protein Fel d 1 Enhances TLR Activation by Lipid Ligands. DOI: 10.4049/jimmunol.1300284
- From cats and blackcurrants: structure and dynamics of the sulfur-containing cassis odorant cat ketone. Chemistry & Biodiversity (2014).
- Odorant volatile sulfur compounds in cat urine: occurrence of (+/−)-3,7-dimethyloct-3-sulfanyl-6-en-1-ol and its cysteine conjugate precursor. DOI: 10.1002/ffj.3216
-
Responsiveness of cats (Felidae) to silver vine (Actinidia polygama), Tatarian honeysuckle (Lonicera tatarica), valerian (Valeriana officinalis) and catnip (Nepeta cataria). BMC Vet Res 13, 70 (2017) DOI: 10.1186/s12917-017-0987-6
উত্তর দিন