ধরো, তুমি একজন অসাধারণ বিজ্ঞানী। আরও ধরে নাও যে তুমি একটা নতুন মৌল আবিষ্কার করে ফেলেছ। ১১৯ নাম্বার মৌলটাই তুমি আবিষ্কার করেছ। এখন এটাকে একটা নাম দিতে হবে। তোমার আবার ‘হিরো আলম’ নামটা খুব পছন্দ, তাই তুমি মৌলটার নাম দিলে হিয়ালোমিয়াম। তুমিই তো আবিষ্কারক, তাই না? তুমি যা ইচ্ছা নাম দেবে, সেটাই তো ওই মৌলের নাম হওয়ার কথা, তাই না?


ক্রেডিট: Wellcome Collection
উত্তর হচ্ছে − না। আবিষ্কারক হিসেবে তোমার মৌলটার নাম দেওয়ার অধিকার আছে ঠিকই, কিন্তু সেই নামটাকে অনুমোদন করতে পারবে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বিশুদ্ধ ও ফলিত রসায়ন সংস্থা বা IUPAC (International Union for Pure and Applied Chemistry)।


ছবি: Carol & Mike Werner/Science Photo Library
রসায়নবিদগণ অতিগুরুত্বপূর্ণ এই মৌলগুলোর যৌক্তিক নামকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন অনেক আগে থেকেই। সেটা মোটামুটি ১৭৮০ সালের দিকে, আধুনিক পর্যায় সারণি তৈরি হওয়ার প্রায় ১০০ বছর আগে। নতুন-নতুন মৌলের সংখ্যা যত বাড়তে লাগল, ততই এদের নামকরণের গুরুত্ব বাড়তে লাগল। কিন্তু যে-কোনো একটা নাম হলেই তো হবে না! নাম হতে হবে এমন যা মনে রাখা সহজ হবে এবং যা হবে অনন্য।


ছবি: University of St. Andrews
বহু আলোচনা, সমালোচনা ও বাগবিতণ্ডার পর অবশেষে ১৯১৯ সালে IUPAC (International Union for Pure and Applied Chemistry) প্রতিষ্ঠিত হলো। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ হবে রসায়নের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট প্রমাণ নিয়ম বা স্ট্যান্ডার্ড গড়ে তোলা। মৌল আর যৌগের নামকরণের নিয়ম তৈরি করাও তার কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে।
তো সব ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু মোটামুটি ১৯৪০ সালের মধ্যেই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন সবগুলো মৌল আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সবগুলোর প্রোটন-সংখ্যা ছিল ভিন্ন এবং অনন্য। কিন্তু কোয়ান্টাম রসায়নের কিছু জটিল নিয়ম থেকে ধারণা করা যাচ্ছিল যে আরও মৌলের অস্তিত্ব থাকা উচিত। তো বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, “যদি প্রকৃতিতে আর কোনো মৌল না পাই, তাহলে আমাদের নিজেদেরই সেই মৌল তৈরি করতে হবে।”


ছবি: Michael Dayah তথ্য: IUPAC Commission on Isotopic Abundances and Atomic Weights (CIAAW)
এটা করা তেমন কঠিন কোনো ব্যাপার নয় আসলে। ইতোমধ্যে যে মৌলগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলোর প্রোটন-সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারলেই তো হয়ে গেল! এটা যদি সফলভাবে করা যায় তাহলেই তো আরও নতুন মৌল আবিষ্কার করা সম্ভব! তবে সেরকম করলে এগুলো আর প্রাকৃতিক থাকবে না, এগুলো হয়ে যাবে কৃত্রিম মৌল।
তো আমেরিকা আর রাশিয়ার (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন) বিজ্ঞানীরা এসব কৃত্রিম মৌল তৈরি করতে উঠেপড়ে লাগল। IUPAC ঠিক করল, যে দেশ কৃত্রিম মৌল তৈরিতে সফল হবে, নামকরণের অধিকারও সে দেশই পাবে আর সে নাম তো অবশ্যই IUPAC দ্বারা অ্যাপ্রুভড হতে হবে
এমনিতেই আমেরিকা আর রাশিয়ার মধ্যে দা-কুমড়া সম্পর্ক, তার ওপর আবার এই ধরনের ঘোষণা আসায় দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীব্র হতে লাগল।


ছবি: Lawrence Berkeley National Laboratory
প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়ে মনে পড়ল ট্রান্সফারমিয়াম যুদ্ধের (transfermium wars) কথা। ষাটের দশকের দিক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এই ট্রান্সফারমিয়াম যুদ্ধ চলেছে।
ভ্রু কুঁচকে হয়তো ভাবছ, ট্রান্সফারমিয়াম যুদ্ধ আবার কী জিনিস?
ট্রান্স (trans) মানে পরে আর ফারমিয়াম (fermium) হচ্ছে পর্যায় সারণির ১০০ নাম্বার মৌল। এই যুদ্ধটা হয়েছে ১০০ নাম্বার মৌলের পরের মৌলের নামকরণ নিয়ে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ১০৪ থেকে ১০৯ নাম্বার মৌলগুলো নিয়ে। রাশিয়া, আমেরিকা আর জার্মানির বিজ্ঞানীরা প্রায় একই সময়ে এই মৌলগুলো আবিষ্কার করেছিলেন। তাই তাঁরা এগুলোকে নিজেদের পছন্দমতো নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। এ বলে “আমার নাম রাখব”, ও বলে “আমার নাম রাখব”। এ নিয়েই এঁদের মধ্যে শুরু হয় কথার লড়াই। ঝগড়া-বিবাদ, বাগবিতণ্ডা চলতে থাকে।
অবশেষে ১৯৯৭ সালে IUPAC ঝগড়া থামাতে এলাকার বড়োভাইয়ের মতো এগিয়ে আসে। এসে বলে, “তোরা এত ঝামেলা করিস না। এক কাজ কর। ১০৪ থেকে ১০৯ পর্যন্ত ছয়টা মৌল তোরা তিন দেশ ভাগ করে নে। এই আমেরিকা, তুই ১০৪ আর ১০৬ নিবি। যা এখন। রাশিয়া এদিকে আয়। তুই ১০৫ আর ১০৭ নিয়ে যা। জার্মানি ১০৮ আর ১০৯ নে। এখন যা তো! আবার যদি ঝগড়া করিস, তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।”


ছবি: Lawrence Berkeley National Laboratory
তো IUPAC ১৯৯৭ সালের এই ঝগড়া থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০০২ সালে নতুন মৌলের নামকরণ নিয়ে কিছু নিয়ম তৈরি করে।
১। IUPAC-এর সিদ্ধান্তানুযায়ী যারা আবিষ্কারক হিসেবে গণ্য হবে, তাদেরই অধিকার থাকবে কোনো একটা নাম সুপারিশ করার।
২। মৌলের নামকরণ করা হয় সাধারণত কোনো পৌরাণিক বিষয় বা চরিত্র, কোনো একটা জায়গা বা ভৌগোলিক অঞ্চল, মৌলটির কোনো একটা ধর্ম অথবা কোনো বিজ্ঞানীর নামের সাথে মিল রেখে। নামগুলোকে অনন্য হতে হবে এবং এর ঐতিহাসিক আর রাসায়নিক গুরুত্ব থাকতে হবে।
পৌরাণিক চরিত্রের উদাহরণে বলা যায় প্রোমিথিয়ামের (promethium) কথা। নামটা নেওয়া হয়েছে গ্রিক পুরাণের একটা চরিত্র (prometheus) থেকে। পুরাণমতে, এই লোক দেবতাদের থেকে আগুন চুরি করে মানুষদের দিয়েছিলেন এবং এজন্য তাঁর ভয়াবহ শাস্তি হয়েছিল। নামটা দিয়ে এটা বোঝানো হয়েছে যে কৃত্রিম মৌল তৈরি করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়।
জায়গার নামে মৌলের নাম রাখা হলে সাধারণত জায়গার নামটা হয় মৌলটা যেখানে প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে সেখানে। সুইডিশ গ্রাম Ytterby-এর নামে চারটি মৌলের নাম রাখা হয়েছে। Ytterbium, Yttrium, Erbium ও Terbium.
আইন্সটেনিয়াম (einsteinium), হাইড্রোজেন বোমার ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত এই মৌলটির নাম রাখা হয় পদার্থবিজ্ঞানী আইনস্টাইনের নামে।
৩। নামগুলোর শেষে ‘ium’ থাকতে হবে। (যদিও ২০১৫ সালের সুপারিশ অনুযায়ী ১১৭তম (Tennessine) ও ১১৮তম (Oganesson) মৌলের শেষে যথাক্রমে ‘ine’ ও ‘on’ রাখা হয়েছে)


ছবি: Sputnik/AP
৪। কোনো একটা মৌলের আবিষ্কার যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে IUPAC-এর অ্যাপ্রুভালের আগে একে এর সংখ্যা অনুযায়ী নামে ডাকতে হবে। যেমন − ১১৮তম মৌল ওগানেসনের নাম আবিষ্কারের পূর্বে একে বলা হতো element 118.
৫। একেবারে ফাইনাল নামটা নির্ভর করছে IUPAC-এর অ্যাপ্রুভালের ওপর। IUPAC চাইলে আবিষ্কারকের সুপারিশ করা নাম বাতিল করে দিতে পারে।
৬। অ্যাপ্রুভ হওয়ার পূর্বে অনুমোদনহীন অবস্থায় একে যে নামে ডাকা হতো, সে নাম যদি অ্যাপ্রুভ না হয়, তাহলে সে নাম পরবর্তী আর কোনো মৌলের জন্য দেওয়া যাবে না।
তোমার আবিষ্কৃত মৌল বিনোদিয়ামের কথাই ধরো। তুমি নিজের খুশির জন্য এর নাম দিলে হিয়ালোমিয়াম। কিন্তু IUPAC সে নাম নাকচ করে দিলো। তাহলে এরপরে আর যত মৌল আবিষ্কৃত হবে, তার কোনোটার নামই হিয়ালোমিয়াম দেওয়া যাবে না।
নামকরণের ব্যাপারটা আসলে অতটা সহজ নয়। মৌলের আবিষ্কারকরা প্রথমে কোনো একটা নাম সুপারিশ করবে। এরপরে IUPAC যদি ঠিক মনে করে, তাহলে সেটা অ্যাপ্রুভ করবে। এরপরে পাঁচ মাসের একটি পাবলিক রিভিউ হবে। এরপরে ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল দেওয়া হবে। অ্যাপ্রুভালের ঝামেলা মিটে গেলে ‘Pure and Applied Chemistry’ নামক একটা বৈজ্ঞানিক জার্নালে সেই নামটা প্রকাশ করা হবে।
সুতরাং, বুঝতেই পারছ একটা মৌলের নামকরণ করতে গেলে অনেকগুলো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী, জায়গার নাম ও পৌরাণিক চরিত্রের নামে বিভিন্ন মৌলের নাম রাখা হলেও আজ পর্যন্ত কোনো মৌলের আবিষ্কারক নিজের নামে কোনো মৌলের নাম রাখেননি। এটা দিয়েই বোঝা যায়, প্রকৃত বিজ্ঞানীরা নিজেদের স্বার্থকে পাশে সরিয়ে রেখে দেশ ও দুনিয়ার জন্য কাজ করে যান।
তথ্যসূত্র:
অসাধারণ
ধন্যবাদ। ফ্রিতে ব্যাঙাচি পড়ুন।
ধন্যবাদ। ব্যাঙাচি পড়ুন বিনামূল্যে।