আসলে, একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ প্রতিদিন তার মস্তিষ্কের ১০০ শতাংশই ব্যবহার করেন। অনেকেই মনে করেন, মস্তিষ্কের ১০% ব্যবহার করা হয়। এগুলো ভিত্তিহীন আর শুনলে বিশ্বাস করার প্রয়োজন নেই।
আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ১০০ শতাংশই ব্যবহার করি। বিভিন্ন অংশের কাজ ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের মস্তিষ্ক মোটামুটি ১.৪ কেজি ভরের। মস্তিষ্কে ১০০ বিলিয়নের চেয়ে বেশি স্নায়ুকোষ বা নিউরণ রয়েছে কোষ যা তথ্য বহন করে। আমাদের মস্তিষ্কের প্রায় ১৯ শতাংশ (প্রায় ১৬ বিলিয়ন নিউরন) জায়গা জুড়ে আছে মস্তিষ্কের একটা বিশেষ অংশ, যার নাম ‘কর্টেক্স’। আমাদের পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে শুধু এ অংশটাই উদ্বিগ্ন (concious)। বাকি সবটা যন্ত্রের মতো নিজে থেকেই কাজ করে, যার ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। এক গবেষণায় দেখা গেছে, একটা বেসবলে ব্যাট আঘাত করতে ৫০ শতাংশ মস্তিষ্ক সক্রিয় করতে হয়। তাহলে দৈনন্দিন জীবনের সকল কাজ করতে কতটুকু সক্রিয় করতে হবে?
মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অংশ ব্যবহার না করে আমরা সামান্য হাঁটতেও পারতাম না। সব কাজেই কম-বেশি আমরা আমাদের মস্তিষ্কের ১০০% ব্যবহার করি। কারণ মস্তিষ্ককে শুধু ওই নির্দিষ্ট কাজই করতে হয় না। ভারসাম্য রক্ষা, শারীরবৃত্তীয় কাজসহ আরও নানাবিধ কাজ করতে হয়। যেমন: আমাদের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কানের তিনটি অংশ (বাহির, মধ্য, ভিতর) এবং দেহের বিভিন্ন অস্থি এবং অস্থিসন্ধি থেকে ভ্যাস্টিবুলার সিস্টেমে সংকেত পাঠানো হয়। তারপর মস্তিষ্ক সেটা জটিল প্রক্রিয়ায় বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন অঙ্গে সংকেত পাঠানোর মাধ্যমে ভারসাম্য রক্ষা করে। এখানে মস্তিষ্কের অনেকগুলো অংশ কাজ করে। তাহলে দেখুন, এক দেহের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যই এত কারবার। তাহলে অন্যান্য কাজ করতে কত কিছু করতে হয়! এতে সহজেই বোঝা যায় যে আমরা মোটেও মস্তিষ্কের ১০% ব্যবহার করি না। তাছাড়া, fMRI (Functional Magnetic Resonance Imaging), MRI (Magnetic Resonance Imaging), PET(Positron Emission Tomography) এর মতো বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, খুব সাধারণ কাজ যেমন : হাত-পা নাড়ানো, বসে থাকা ইত্যাদি কাজের সময়ও মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ এক গতিশীল প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত হয়। তবে নিদিষ্ট কাজের সময় নিদিষ্ট কিছু অংশ বেশি অ্যাক্টিভ থাকে যেমন: দেখার সময় ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স, শোনার সময় অডিটরি কর্টেক্স ইত্যাদি৷
মস্তিষ্ক ১০০%-ই কাজ করে। কিন্তু মস্তিষ্কের ১০০%-ই মানুষ তার চিন্তায় ব্যয় করতে পারে না। কারণ মস্তিষ্কের একেক অংশের কাজ একেকটা যেটা আমি আগেই বলেছি। যে অংশ নার্ভাল সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ করে, সে অংশ চিন্তা করতে পারে না। এমনকি ঘুমের ভেতরেও মস্তিষ্কের মেমোরি সংক্রান্ত পার্ট অ্যাক্টিভ থাকে এবং স্মৃতি গোছানোর কাজে ব্যস্ত থাকে। আমরা মস্তিষ্কের নিউরনগুলার মধ্যে সঠিকভাবে সমন্বয় করতে পারি না যার জন্য অনেকে অনেক মেধাবী আর অনেকে দুর্বল হয়ে থাকে। কিন্তু অনুশীলন করলে মস্তিস্কের সমন্বয় সাধন সহজ হয়, আর আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতাও বাড়ানোও সম্ভব।
এবার আসি ‘আমরা মস্তিষ্কের ১০% ব্যবহার করি’ তার ব্যাপারে।
আসলে, ব্যাপারটা একটা মনগড়া গল্প যেটা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি যে এই ১০% কোথা থেকে এলো। তবে ধারণা করা হয় কয়েকটা কারণকে। যেমন: ১৯০৭ সালে প্রকাশিত ‘SCIENCE‘ বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে উইলিয়াম জেমস তাঁর এক প্রবন্ধে লেখেন, “মানুষ তার মস্তিষ্কের কিছু অংশ ব্যবহার করে।”


আবার ১৯৩৬ সালে ডেল কার্নেগির প্রকাশিত বই ‘How to Win Friends and Influence People‘-এ তিনি ১০% ব্যাপারটা উল্লেখ করেছিলেন। এখানে তিনি সেটা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে মস্তিষ্ক অনেক কিছু করতে পারে।কিন্তু তিনি নির্দিষ্ট করে কত শতাংশ তা বলেননি শুধু বোঝানোর কাজে ১০% কথাটি তুলে ধরেছিলেন।


তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ, টেলিভিশন অনুষ্ঠান বা সিনেমাতে এরকম ব্যাপার অনেকবার বলা হয়েছে। এমনকি এখনও কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আমাদের মস্তিষ্কের মাত্র ১০% কোষে নিউরন সক্রিয়। কিন্তু এই ১০% ব্যাপারটা বেশি ছড়িয়েছে ইন্টারনেট আর সিনেমার মাধ্যমে।


© EuropaCorp
অনেকে হয়তো লুক বেসনের সায়েন্স ফিকশন Lucy (2014) সিনেমাটি দেখে থাকবেন। যে সিনেমাটিতে স্কারলেট জোহানসন এবং মরগান ফ্রিম্যানের মতো বিখ্যাত অভিনয় শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। সেখানে ওই ১০% এর যে গুজব সেটা দেখানো হয়েছে। ২৫ বছরের অ্যামেরিকান মেয়ে লুসি তাইওয়ানে লেখাপড়া করতে গিয়ে ড্রাগ মাফিয়াদের সাথে জড়িয়ে পড়েন। তারপর CPH4 নামের একটি ন্যুট্রপিক (Nootropic, এক শ্রেণীর ড্রাগ যা মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে) ড্রাগ তাঁর শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পাচার করার জন্য। কিন্তু তাঁর শরীরে সেটা ফেঁটে যায় এবং সেই ড্রাগের প্রভাবে তাঁর মস্তিষ্কের অনেক অংশ সক্রিয় হয়ে যায়; যেটা সে ব্যবহার করতে পারে, আর একসময় সেটা ১০০% এ পৌঁছে যায়।
সিনেমাটি অসাধারণ। কিন্তু তাতে যা দেখানো হয়েছে সেটা মোটেও সত্যি নয়। আমরা প্রতিদিন মস্তিষ্ককে কোনো না কোনোভাবে ১০০%-ই ব্যবহার করে থাকি।
তাছাড়া বিবর্তনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাকালে দেখতে পারবেন, দেহের মোট ভরের মাত্র ২ শতাংশ জায়গা দখল করা মস্তিষ্ক দেহের ২০ ভাগ শক্তি ব্যবহার করে; যেখানে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণী ২-১০% শক্তি ব্যবহার করে। মস্তিষ্ক দীর্ঘ সময়ের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ফল। তাই মস্তিষ্কের বিশাল অংশ অব্যবহৃত থাকলে অর্থাৎ তার থেকে কোনো সুবিধা পাওয়া না গেলে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে যেত। যদি ১০%-ই ব্যবহার করতে হতো তাহলে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এটা ছোটোই থাকত; বাড়তি ৯০% হতো না।
সূত্র:
- Herculano-Houzel S (2009). The human brain in numbers: a linearly scaled-up primate brain. Front. Hum. Neurosci. 3:31. doi: 10.3389/neuro.09.031.2009
- Sie, JH., Chen, YH., Chang, CY. et al. Altered Central Autonomic Network in Baseball Players: A Resting-state fMRI Study. Sci Rep 9, 110 (2019). doi: 10.1038/s41598-018-36329-9
- Guo Z, Li A and Yu L (2017) “Neural Efficiency” of Athletes’ Brain during Visuo-Spatial Task: An fMRI Study on Table Tennis Players. Front. Behav. Neurosci. 11:72. doi: 10.3389/fnbeh.2017.00072
- Do People Only Use 10 Percent of Their Brains? – Scientific American
উত্তর দিন