বাষ্পীয় ইঞ্জিন আসলে কে আবিষ্কার করেন?

বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কার নিয়ে বেশ বড় একটা দ্বিধা রয়েছে আমাদের সবার মধ্যে। আবার অনেকে জানেন বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারক জেমস ওয়াট। কিন্তু আসলেই কি তাই? তো চলুন দেখা যাক বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিষ্কারের পেছনের কাহিনি।

aeolipile, বা primitive steam turbine.

ইয়োলিপাইল: হিরোর ইঞ্জিন

১ম শতকে আলেকজান্দ্রিয়ায় একজন গণিতবিদ ও যন্ত্রপ্রকৌশলী থাকতেন। বড্ড সহজ-সরল জীবনযাপন করতেন নিজ গ্রামে। মুখে সহজ-সরল বললেও প্রকৌশলী আর গণিতবিদ হওয়ার খাতিরে হয়তো তাঁর মাথায় নানা কিছু ঘুরতেই থাকত। তিনি হলেন আলেকজান্দ্রিয়ার হিরো। উঁহু, তিনি কমিক্স বা চলচ্চিত্রের হিরো নন, তাঁর নামই হিরো (Heron)। বলা যায় তাঁর হাত দিয়ে প্রথমে বাষ্পচালিত কিছু একটা মানবজীবনে এসেছে। এটা অপূর্ণাঙ্গ। ঠিক আধুনিক ইঞ্জিনের মতো নয়। বাষ্পীয় টারবাইন। এর নাম ইয়োলিপাইল।

a bottle jack

স্টিম জ্যাক

তাকি-আদ-দ্বিন সর্বপ্রথম বাষ্পচালিত এই জ্যাক তৈরি করেন। জ্যাক ব্যবহৃত হয় ভারি কোনো বস্তু তোলার জন্য। রোস্টিং জ্যাকের একটি ছবি দেওয়া হয়েছে যেখানে মাংস রোস্ট করা হচ্ছে। বাষ্পচালিত এই জ্যাকও কোনো প্রপার ইঞ্জিন নয়। ইতিহাসের পাতার দুইজনের নাম আর তাঁদের বাষ্প নিয়ে কাজ জানলাম। কোনোটাকেই ইঞ্জিন বলা গেল না।

এবার আস্তে আস্তে আমরা পরিপূর্ণ বাষ্পীয় ইঞ্জিন সম্পর্কে জানা শুরু করব।

Thomas Savery’র machine

ফায়ার ইঞ্জিন অ্যাক্ট: টমাস সাভেরির আগমন

১৬৯৮ সালে টমাস সাভেরি সর্বপ্রথম এই ইঞ্জিন তৈরি করেন। একটি পরিপূর্ণ বাষ্পীয় ইঞ্জিন। তিনি [রয়েল ]সোস্যাইটির সামনে এই যন্ত্র ১৬৯৯ সালে উপস্থাপন করেন। কিন্ত এর কলাকৌশল তখনো অপ্রকাশিত ছিল। পরে ১৭০২ সালে এই ইঞ্জিনের কলাকৌশল লিখে একটা বই প্রকাশ করেন টমাস সাভেরি। The Miner’s Friend; or, An Engine to Raise Water by Fire বইয়ে তিনি যন্ত্রটি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

Fire pump, Savery system, 1698
Wikimedia

তাঁর ইঞ্জিনের সাহায্যে পানি এক পাত্র থেকে অন্যপাত্রে নিয়ে কাজ করার কৌশল ছিল অনেকটা এরকম:

বয়লারে গরম বাষ্প তৈরি হয়।

গরম বাষ্প ইঞ্জিনের ফাঁকা ভেসেলে প্রবেশ করে এবং ভেসেলগুলোকে পূর্ণ করে।

ভেসেলগুলো পাইপ দ্বারা যুক্ত থাকে। গরম বাষ্প এই পাইপ দিয়ে পানি পূর্ণ ভেসেলে প্রবেশ করে।

ভেসেলগুলো বাষ্প দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেলে বয়লার এবং ভেসেলের মধ্যকার পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

পানিপূর্ণ ভেসেলে বাষ্প প্রবেশের ফলে পানির ও[ওপর] চাপ বৃদ্ধি পায়। এসময় উত্তপ্ত বাষ্প পূর্ণ ভেসেলকে বাইরে থেকে ঠান্ডা করে।

ফলে আংশিক শূন্যস্থান সৃষ্টি হয় পানিশূন্য ভেসেলে। ফলে এখানে চাপ কমে যায়, ভেসেল এবং বয়লারের মধ্যকার পাইপের মুখ আবার খুলে যায়।

পানিপূর্ণ ভেসেলে চাপ বাড়ার ফলে সেখান থেকে পানি ঊর্ধ্বমুখী পাইপ দিয়ে পানিশূন্য ভেসেলে আসে।

এই ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা কম ছিল। অধিক পরিমাণে শক্তির অপচয় ঘটত এই ইঞ্জিনে। কিন্ত এটি ছিল প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন। ওই সময়ে এই কৌশল অবলম্বন করে যত ইঞ্জিন তৈরি করা হয়েছে সবকিছুর ক্রেডিট দেওয়া হয় টমাস সাভেরিকে। এর জন্য পাশ হয়েছিল ‘ফায়ার ইঞ্জিন অ্যাক্ট’।

নিউকোমেন থেকে জেমস ওয়াট

টমাস সাভেরিকে বলা হয় বাষ্পীয় ইঞ্জিনের জনক। আমাদের বইগুলোতে পড়ানো হয় জেমস ওয়াট হলেন বাষ্পীয় ইঞ্জিনের জনক। এরকম গল্পও শুনেছি, “জেমস ওয়াট একদিন চায়ের কেতলিতে চা গরম করছিলেন। কেতলির মুখ দিয়ে বাষ্প বের হচ্ছিল। তা দেখে হঠাৎ তাঁর মাথায় কিছু একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তিনি কেতলির মুখ কাগজ দিয়ে বন্ধ করে দেন। কিছু সময় পর দেখা যায়, বাষ্পের চাপে কেতলির মুখ হতে কাগজ ছুটে দূরে গিয়ে পড়ছে। এ থেকে তাঁর মাথায় বাষ্পীয় ইঞ্জিন তৈরির আইডিয়া আসে।”

এটা মনে হয় নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার মতোই একটা গল্প। গল্পের সত্যতা কতটা ঠিক তা না জানলেও বাষ্পীয় ইঞ্জিন যে জেমস ওয়াট তৈরি করেননি তা ইতিহাস থেকেই জানা যায়।

টমাস সাভেরির ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্য টমাস নিউকোমেন এই যন্ত্রে পিষ্টন যোগ করেন যা পানির ওপর চাপ বাড়িয়ে দিত। পরবর্তীতে জেমস ওয়াট এই ইঞ্জিনে কনডেন্সার যোগ করে এর কার্যক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে দেন। এরপর অনেকভাবেই এই ইঞ্জিনের উন্নতি সাধন হয়েছে। কিন্ত “বাষ্পীয় ইঞ্জিনের জনক কে?” এ এই প্রশ্ন এলে একটাই নাম শোনা যাবে’—‘টমাস সাভেরি’।

সুত্র: স্ট্যানফোর্ড ব্লগ