১.
মেন্ডেলিফের মহান আবিষ্কার, পর্যায় সারণির দিকে তাকালেই এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। অবশ্য তার একটা কারণও আছে। খুব মজা লাগে যখন পর্যায় সারণি দেখে চট করে কোনো একটি মৌলের পরমাণুর গঠন, ধর্ম, বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মোটামুটি নিখুঁত একটা ধারণা পাওয়া যায়। পর্যায় সারণির ১১৮টি মৌলের কেবল একটি বিষয়ই সারণি থেকে পাওয়া যায় না। সেটা হলো এসকল মৌলের সৃষ্টি রহস্য।
পর্যায় সারণি থেকে শুধু বলা যায় যে, ১১৮টি মৌলের মধ্যে ৯৪টি প্রাকৃতিক, বাকিগুলো মানবসৃষ্ট। কিন্তু সহজ কথায় মন কি ভরে? মনের মধ্যে জাগে নানান রকমের প্রশ্ন। কীভাবে এদের সৃষ্টি হলো? প্রকৃতিতে এদের উৎপত্তি কীভাবে? বিজ্ঞানীরাই বা কীভাবে বানালেন এদের?
ধারণ করা হয় আমাদের এই চিরপরিচিত বিশ্বজগতের সূচনা প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন (১৩,৮০০,০০০,০০০) বছর আগে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে। অসীম ঘনত্ব ও তাপসম্পন্ন একটি বিন্দুর প্রসারণের মাধ্যমে এই জগতের জন্ম। বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে যেমন এ জগতের জন্ম, তেমনি মৌল সৃষ্টির গল্পের জন্মও এই সময়। বিগ ব্যাং ঘটার ৩ মিনিট পর শুরু হয় এ কর্মযজ্ঞ, যা চলতে থাকে পরের ১৭ মিনিট অব্দি। এসময় প্রোটন ও নিউট্রন সমন্বয়ে মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি হতে থাকে। এই নিউক্লিয়াস গঠনের ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানীরা বলেন বিগ ব্যাং নিউক্লিয়োসিনথেসিস (Big Bang Nucleosynthesis)। এরপর রিকম্বিনেশনের সময়ে ইলেকট্রনকে সঙ্গী করে নিউক্লিয়াসগুলো। আর এভাবে তৈরি হয় আস্ত এক একটা পরমাণু। তবে পর্যায় সারণির সবকটা মৌল এসময় তৈরি হয়নি। ধারণা করা হয়, বড়োজোর ৫টি মৌল এসময় তৈরি হয়েছিল। এসময় যত মৌল তৈরি হয়েছিল তার প্রায় ৭৫% হাইড্রোজেন, ২৪% হিলিয়াম আর বাকি ১% এ রয়েছে লিথিয়াম, বেরিলিয়াম ও বোরন। এর পরে কেটে যায় বহু বহু বছর। মহাবিশ্বের আনাচে কানাচে হাইড্রোজেন গ্যাস ঘনীভূত হয়ে তারার জন্মের প্রস্তুতি চলতে থাকে। বিগ ব্যাং ঘটবার প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর পরে প্রথমবারের মতো জ্বলে ওঠে আদিম তারাদের আলো। সাথে সাথে নতুন করে শুরু হয় মৌল তৈরির কর্মযজ্ঞ। এবার আর বিগ ব্যাং নয়, রাতের আকাশের তারাগুলো কিংবা দিনের আকাশের সূর্য শোনাবে মৌল সৃষ্টির গল্প।
২.
আকাশের তারা কিংবা দিনের সূর্য সবই নক্ষত্র। সাধারণভাবে নক্ষত্রদের ছোটো, মাঝারি আর বড়ো এই তিন ভাগে ভাগ করা হয়। সব রকমের তারাই মৌল তৈরি করে, কিন্তু কারো ভূমিকা একটু বেশি, আবার কারো একটু কম।
ছোট্ট আর মাঝারি তারাদের থেকেই বরং শুরু করি (এ ক্যাটাগরিতে আমাদের সুয্যিমামাও শামিল)। এ তারাগুলো পর্যাপ্ত তাপমাত্রা পেলে এদের ভেতরে থাকা হাইড্রোজেনে ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করে। এর ফলে তৈরি হয় হিলিয়াম এবং শক্তি। এই তাপীয় শক্তি মহাকর্ষের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, যার ফলস্বরুপ তারাটি টিকে থাকে।
তারাদের জীবনের শুরু থেকেই তাদের নিজেদের তাপীয় চাপ আর মহাকর্ষের মধ্যে ভারসাম্য ধরে রাখার খেলা শুরু হয়! মহাকর্ষের পরিবর্তন হয় না, কিন্তু তাপীয় চাপ কমলেই শুরু হয় তারাদের মৃত্যুপথে যাত্রা।
বিলিয়ন বছর ধরে এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে। একসময় কেন্দ্রের সব হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যায়, তখন তাপীয় চাপ আর মহাকর্ষের সাথে লড়াই করে পেরে ওঠে না। মহাকর্ষ বিজয়ীর বেশে পুরো নক্ষত্রটিকে সংকুচিত করতে শুরু করে। এই সংকোচন তারাটির ভেতরের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে এমন অবস্থায় নিয়ে যায়, যা হিলিয়ামকে ফিউজ করার উপযোগী। আর সত্যি সত্যিই হিলিয়ামের ফিউশন শুরু হয়, তাপীয় চাপ বেড়ে গিয়ে নক্ষত্রটির আকার স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। এ অবস্থাকে বলে রেড জায়ান্ট ফেইজ।
একটা সময় হিলিয়ামও শেষ হয়ে যায়। তখন নক্ষত্রের ভেতরে থাকে ফিউশন প্রোডাক্ট হিসেবে সৃষ্ট কার্বন আর অক্সিজেন। এ পর্যায়ে তারাদের বাইরের স্তর আস্তে আস্তে উড়ে যায় স্টেলার উইন্ডের মাধ্যমে আর এভাবেই তারাটির প্রায় ৫০% ভর নিয়ে তৈরি হয় প্ল্যানেটরি নেবুলা! আর তার ছোট্ট কেন্দ্রে বাকি ৫০% ভর নিয়ে শ্বেত বামন হিসেবে জীবন কাটাতে থাকে। শ্বেত বামন আকারে খুব ছোটো কিন্তু তার ঘনত্ব যে বেশি তা বুঝতেই পারছেন। বিষয়টিকে আমাদের চারপাশের জগতের সাথে একবার তুলনা করা যাক। মনে করি, আমরা শ্বেত বামন তারার পৃষ্ঠ থেকে ১ চা চামচ পদার্থ নিয়ে আসলাম। এর ভর কীরূপ হতে পারে কেউ কি আন্দাজ করতে পারছেন? এর ভর প্রায় একটি গাড়ির সমান হবে!
শ্বেত বামন তারারা সাধারণত নতুন মৌল তৈরি করে না। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে। বাইনারি স্টার সিস্টেমের কোনো তারা যদি শ্বেত বামনে পরিণত হয়, সেখানে কখনো কখনো একটি আকর্ষণীয় ঘটনা ঘটবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। সে তার মহাকর্ষ বল দিয়ে অন্য তারাটির কাছ থেকে পদার্থ কেড়ে নিতে থাকে। একপর্যায়ে এই লুণ্ঠিত পদার্থের পরিমাণ এত বেশি হয়ে যায় যে তারাটি আর তা ধরে রাখতে পারে না। শ্বেত বামন তারাটি সংকুচিত হতে শুরু করে আর একটি বিস্ফোরণ ঘটে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, তার মধ্যে সঞ্চিত সকল পদার্থ থাকে। এই বিস্ফোরণ হলো একধরনের সুপারনোভা, আরও বিস্তারিত বললে বলতে হবে টাইপ ওয়ান সুপারনোভা।
এবারে আসি বড়ো তারাদের কথায়। আমাদের সূর্যের চেয়ে কমপক্ষে ১.৪ গুণ ভারী তারাদের বলা হয় বড় নক্ষত্র। বড় তারাগুলোও তাদের জীবন শুরু করে হাইড্রোজেনকে ফিউজ করে হিলিয়াম তৈরির মাধ্যমে। এরাও রেড জায়ান্ট ফেইজের মধ্য দিয়ে যায়, তবে আরও বড় রেড সুপার জায়ান্ট (RSG) ফেইজ।
সুপার রেড জায়ান্ট ছোটো কিংবা মাঝারি তারাদের মতো কার্বন-অক্সিজেন তৈরি করেই ক্ষান্ত হয় না, কার্বন আর অক্সিজেনেরও ফিউশন শুরু করে! কেন? – ছোটো তারাদের ভর কম, মহাকর্ষ বলও তাই তুলনামূলকভাবে কম। এজন্য সে নক্ষত্রের ভেতরে কার্বন ফিউজ করার মতো তাপ-চাপ সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু বড়ো তারাগুলোর ভর যেমন বেশি, তেমনি মহাকর্ষ বলও প্রচণ্ড। আর এই প্রচণ্ড মহাকর্ষ বল দিয়ে নিজেকে সংকুচিত করার চেষ্টা করে মারাত্মকভাবে, যা কার্বনের ফিউশনের জন্য প্রয়োজনীয় চাপ আর তাপ সহজেই যোগান দিতে পারে। একটা জ্বালানি থেকে আরেকটি জ্বালানি তৈরির কাজ চলতেই থাকে, যতক্ষণ না লোহা তৈরি হয়। তবে মনে রাখা ভালো, জায়ান্ট ফেইজে নক্ষত্রের পুরোটা জুড়েই কিন্তু হিলিয়ামের ফিউশন, কার্বনের ফিউশন ঘটে না। নক্ষত্রের এক এক স্তরে তাপ আর চাপ এক এক রকম, ভেতর থেকে বাইরের দিকে ক্রমাগত কমতে থাকে। তাই এক এক স্তরে প্রয়োজনীয় তাপ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন মৌলের ফিউশন ঘটে। বাইরের শেলে হাইড্রোজেন, ভেতরে হিলিয়াম এভাবে এগিয়ে যেতে যেতে সব শেষে কেন্দ্রে ঘটে সিলিকন থেকে লোহা তৈরির প্রক্রিয়া। ব্যাপারটাকে অনেকটা পেঁয়াজের স্তরগুলোর সাথে তুলনা করা যায় (উপরের ছবি লক্ষ্য করুন)। বড় নক্ষত্রগুলোর মাঝে এভাবেই তৈরি হয় হিলিয়াম থেকে লোহা পর্যন্ত মৌলগুলোর নিউক্লিয়াস, তবে ফিউশনের সময় বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে কাছাকাছি পারমাণবিক সংখ্যাযুক্ত কিছু নিউক্লিয়াসও অল্প পরিমাণে তৈরি হয় যা নিচের ছকে দেখানো হয়েছে।
তবে ফিউশনই একমাত্র পথ নয়। ছোটো বড় সব তারকাই নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস (r-process)-র মাধ্যমেও বিভিন্ন মৌল তৈরি করতে সক্ষম, এমনকি লোহা থেকেও ভারী মৌলও তারার মাঝে এভাবে তৈরি হতে পারে। নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেসটা আসলে কী সেটা আগে দেখে নেওয়া যাক।
নাম শুনেই বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা নিউট্রনকে ক্যাপচার করার অর্থাৎ ধরে ফেলার। হ্যাঁ, সহজ করে বলতে গেলে এটাই এই প্রক্রিয়ার মূল বিষয়! একটি নিউট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ঢুকে গিয়ে ওই মৌলের একটি আইসোটোপ তৈরি করে। এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ না মৌলটার আইসোটোপ অস্থিতিশীল হয়ে যায়। অস্থিতিশীল নিউক্লিয়াসের অতিরিক্ত নিউট্রনটি বিটা রেডিয়েশনের মাধ্যমে একটা ইলেকট্রন আর প্রোটনে রূপ নেয়। ইলেকট্রনটা নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঘুরতে থাকে আর প্রোটন থেকে যায় নিউক্লিয়াসে, যেমনটা তাদের থাকার কথা। এভাবে তৈরি হয় নতুন মৌল।
পুরো ব্যাপারটি খোলাসা করবার জন্য লোহার নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেসের মাধ্যমে নতুন মৌল তৈরির ব্যাপারটা দেখে নিই। (Iron-56) পরমাণুটি একটি নিউট্রন ক্যাপচার করে পরিণত হয় (Iron-57) আইসোটোপে। এভাবে একটা একটা করে নিউট্রন ক্যাপচার প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় লোহার আরেক আইসোটোপ (Iron-59)। তবে এ আইসোটোপের নিউক্লিয়াস আবার অস্থিতিশীল। তার একটা নিউট্রন এসময় বিকিরণের মাধ্যমে ইলেকট্রন আর প্রোটনে রূপ নেয়। পরমাণুটির পারমাণবিক সংখ্যা এক ঘর বেড়ে যায়। তাই তখন সে আর লোহার পরমাণু থাকে না, সে হয়ে যায় কোবাল্ট। তারাদের জীবনকালে তাদেরই মাঝে লোহা থেকে ভারী মৌলগুলো নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেসের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়। তবে প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে নতুন মৌল বা এক আইসোটোপ থেকে আরেক আইসোটোপে পরিণত হতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। যেমন (Iron-56) থেকে (Iron-57) হওয়ার পর আরেকটি নিউট্রন ক্যাপচার করে (Iron-58) হওয়ার জন্য পরমাণুটাকে প্রায় হাজারখানেক বছর অপেক্ষা করতে হয়!
৩.
তারাদের জন্ম থেকে যেমন বিভিন্ন মৌল সৃষ্টি হয়, তেমনি তাদের মৃত্যুও নতুন মৌল সৃজনে অংশীদার। তবে এবার ফিউশনে মৌল তৈরি হয় না, পদ্ধতিটা কিছুটা ভিন্ন।
ছোটো আর মাঝারি নক্ষত্রদের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। তাই এবার কথা হবে শুধুমাত্র বড়ো নক্ষত্রদের বিষয়ে। এজন্য আমরা ফিরে যাব তাদের কেন্দ্রে লোহা তৈরির কথায়। লোহার কিন্তু ফিউশন সম্ভব নয়। কারণ লোহার নিউক্লিয়াস () এ জগতে সবচেয়ে স্থিতিশীল (তবে এর কিছু আইসোটোপের কথা আলাদা)। এখন প্রশ্ন হলো, নিউক্লিয়াস স্থিতিশীল হলে কেন ফিউশন হবে না? আসলে ফিউশনের মূলকথার মাঝে এর উত্তর লুকিয়ে আছে। ফিউশনে হালকা মৌলের নিউক্লিয়াস জুড়ে ভারী মৌল তৈরি হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নিউক্লিয়াসগুলো সবসময় একটা বেশি স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসে পরিণতি লাভ করতে চায়। হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হিলিয়ামের চেয়ে কম স্থিতিশীল, তাই হাইড্রোজেন ফিউজ হয়ে তৈরি হয় হিলিয়াম। হিলিয়ামের পর আরও স্থিতিশীল কার্বন, তাই হিলিয়ামের ফিউশনে তৈরি হয় কার্বন (এজন্য তারাদের মাঝে বেশি একটা লিথিয়াম, বেরিলিয়াম পাওয়া যায় না; তবে এরাও মাঝে মাঝে তৈরি হয় ফিউশনের মাধ্যমে)। কিন্তু লোহার চেয়ে ভারী মৌলগুলো লোহার নিউক্লিয়াসের চেয়ে বেশি স্থিতিশীল নয়। তাই লোহার ফিউশন আর সম্ভব হয় না!
বড় তারাদের কেন্দ্রে যখন সব মৌল লোহায় পরিণত হয়ে যায়, তখন আর লোহার ফিউশন হয় না, কমে যায় তাপীয় চাপ। তাপীয় চাপ আর মহাকর্ষের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়, আবার জয় হয় মহাকর্ষের। আলোর প্রায় ২৫ শতাংশ গতিতে তারকাটি সংকুচিত হয়ে তার মৃত্যুপথে যাত্রা শুরু করে। এই সংকোচনের সময়ই চলে মৌল তৈরির খেলা! র্যাপিড নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেসের মাধ্যমে তৈরি হয় আয়োডিন (I), জেনন (Xe), সোনা (Au), ইউরেনিয়াম (U), প্লুটোনিয়াম (Pu)-এর মতো সব ভারী ভারী মৌল। তাও মুহূর্তের মধ্যে, কারণ এটা র্যাপিড নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস, নামের সাথেই ‘র্যাপিড’। তারাদের জীবনকালে ঘটা সাধারণ নিউট্রন ক্যাপচার নয়। এবারে আর হাজার হাজার বছর অপেক্ষা করার কোনো বালাই নেই।
অন্যদিকে মহাকর্ষ তারাটির লৌহপূর্ণ কেন্দ্রের প্লাজমাকে এমন চাপ দেয় যে ইলেকট্রন-প্রোটন এক হয়ে নিউট্রন হয়ে যায়, যেটা মূলত হওয়ার কথা না। এভাবেই বড় তারাদের কেন্দ্র নিউট্রন স্টারের রূপ ধরে! তারাটির আউটার শেলগুলো যখন এই কেন্দ্রকে আঘাত করে তখন এই শক্তির বিপরীতমুখী প্রভাব তারাটির বাইরের স্তরকেই পুরো বিস্ফোরিত করে। আর আমরা দেখতে পাই সুপারনোভার মতো একটা ভয়ংকর সুন্দর ঘটনা। তবে বড় তারাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই সুপারনোভাকে বলে টাইপ টু সুপারনোভা (Type II supernova)।
কিন্তু সকল বড় তারাই সুপারনোভার পর নিউট্রন স্টার রূপে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে না। আমাদের সূর্যের থেকে প্রায় ৩ গুণ বা তার চেয়ে বেশি ভারী তারাদের মহাকর্ষ এত বেশি হয় যে, পুরো কেন্দ্রটা পরিণত হয় অসীম ঘনত্বের একটা বিন্দুতে, যাকে বলে ব্ল্যাকহোল। বৈজ্ঞানিক মহলে শোনা যাচ্ছে যে, ব্ল্যাক হোলের অ্যাক্রেশন ডিস্কেও নিউক্লিওসিনথেসিসের মাধ্যমে ভারী মৌল তৈরি হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনো আরও গবেষণা ও প্রমাণ প্রয়োজন।
৪.
চলুন এবার পাড়ি দিই কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের একটি বাইনারি স্টার সিস্টেমে। তবে যে-কোনো বাইনারি স্টার সিস্টেমে গেলে হবে না, যেতে হবে এমন একটা স্টার সিস্টেমে যেখানে দুটি তারাই নিউট্রন স্টার! নিউট্রন স্টার দুটো ক্রমাগত শক্তি বিকিরণ করতে থাকে, তাদের কক্ষপথেরও পরিবর্তন হতে থাকে। একসময় তারা আঁছড়ে পড়ে একে অপরের ওপর! এই দুই তারার সংঘর্ষে একটি বিস্ফোরণ ঘটে, যাকে বলা হয় কিলোনোভা। সুপারনোভার পর তারাদের পুনর্জন্মের মতো ব্যাপার-স্যাপার কিলোনোভার ক্ষেত্রেও ঘটে কি না তা এখনো আমাদের কাছে অজানা। কিলোনোভায় তারাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, না কি ব্ল্যাকহোলের জন্ম হয় এসব নিয়ে আরও পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা প্রয়োজন। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, তারা দুটির বিভিন্ন উপাদান ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে আর তৈরি হয় ভারী ভারী সব মৌল। কেমন করে? এটার রহস্য লুকিয়ে আছে নিউট্রন স্টারের আউটার শেল আর সেই র্যাপিড নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেসের কাছে। নিউট্রন স্টারের অধিকাংশই শুধু নিউট্রন দিয়ে তৈরি হলেও বাইরের শেল লোহার নিউক্লিয়াস দ্বারা গঠিত। এখানে র্যাপিড নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস চলতে থাকে কিলোনোভার সময়। এক একটি নিউক্লিয়াস অনেকগুলো নিউট্রন নিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে আর নিউক্লিয়াসের মাঝে এই অতিরিক্ত নিউট্রনের ইলেকট্রন ও প্রোটনে রূপান্তর সৃষ্টি করে নতুন নতুন মৌল। আর জন্ম নেয় ইউরেনিয়াম, সোনা, প্লাটিনামের মতো ভারী ভারী মৌল। এখন থেকে প্রায় ১০০ বছর আগেই বিজ্ঞানীরা কিলোনোভা সম্পর্কে আন্দাজ করেছিলেন। তবে বছর তিনেক আগেও কিলোনোভায় মৌল তৈরি হয় কি না দূরে থাক, কিলোনোভার মতো ঘটনা ঘটে কি না তাই নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ ছিল। কেউ কোনো প্রমাণ পাননি। কিন্তু এখন এর প্রমাণ মিলেছে। ২০১৭ সালের ১৭ই আগস্ট LIGO, VIRGO এবং আরও কয়েকটি অবজারভেটরি প্রায় ১৩ কোটি আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ GW170817 শনাক্ত করে। সাথে অবশ্য বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গেরও দেখা মেলে। বিচার-বিশ্লেষণ শেষে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হলেন এটি নিশ্চয়ই কোনো বাইনারি নিউট্রন স্টার সিস্টেমের দুটি নিউট্রন স্টারের সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট কিলোনোভার শকওয়েভ। বিজ্ঞানীরা ২০১৯ সালে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ বিশ্লেষণ করে কিলোনোভার ১ মিনিটের মাঝে স্ট্রনশিয়াম (Sr) তৈরি হবার প্রমাণ পেয়েছেন। আর পরে পাওয়া গেছে আরও ভারী মৌলের সন্ধান, যা কিলোনোভায় মৌল সৃষ্টির বিষয়টির সত্যতার জানান দেয়।
৫.
এবারে আলোচনা হবে মৌল সৃজনে নিউক্লিয় বিকিরণের ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু তার আগে নিউক্লিয় বিকিরণের প্রকারভেদ সম্পর্কে একটু জেনে নিতে হবে। প্রকারভেদ বুঝতে পারলেই মৌল সৃষ্টির রহস্যটা বোঝা যাবে। নিউক্লিয় বিকিরণের রয়েছে তিনটি ধরন – আলফা (α), বিটা (β) আর গামা (γ) বিকিরণ। প্রথমেই বলে রাখি গামা বিকিরণে সরাসরি পরমাণুর নিউক্লিয়াসের তেমন একটা পরিবর্তন হয় না, শুধু বাড়তি শক্তি বেরিয়ে যায়। তবে আলফা আর বিটা বিকিরণ তেমন ধারার নয়।
সহজ করে বলতে আলফা বিকিরণে একটা নিউক্লিয়াস থেকে হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বেরিয়ে যায় আর পারমাণবিক সংখ্যা কমে দুই ঘর!
আর বিটা বিকিরণে নিউট্রন কিংবা প্রোটনের পরিবর্তন হয়। একটি নিউট্রন ভেঙে একটি করে প্রোটন, নিউট্রন এবং এন্টি-নিউট্রিনো বের হয়। অর্থাৎ পরমাণুর প্রোটন ও ইলেকট্রন সংখ্যা বেড়ে যায় আর নতুন পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট একটি মৌল তৈরি হয়। আবার প্রোটন ভেঙে নিউট্রন, পজিট্রন আর নিউট্রিনো তৈরি হয়। পজিট্রন ইলেকট্রনের সাথে মিলে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। প্রোটন সংখ্যা একঘর কমে যায়, আর নতুন একটা মৌল সৃষ্টি হয়।
ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়ামের মতো ভারী ভারী মৌল কিংবা হালকা মৌলের ভারী আইসোটোপগুলোর নিউক্লিয়াস সাধারণত অস্থিতিশীল হয়। এদের নিউক্লিয়াসের পরিবর্তন ঘটে নতুন মৌল সৃষ্টি হয়। সময়ের আবর্তনে এসব মৌলের নিউক্লিয়াস নানা ধরনের বিকিরণ করতে করতে স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসযুক্ত মৌলে পরিণত হয়। তারপর বিকিরণ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়।
৬.
কসমিক রে! নাম শুনেই মনে হচ্ছে এটা বুঝি কোনো এক ধরনের রশ্মি। আদতে তা সত্য নয়। তবে ভুল ভাবলেও সমস্যা নেই। কারণ ১৯১২ সালে প্রথম যখন এদের শনাক্ত করা হয়, বিজ্ঞানীরাও এমন ভুল করেছিলেন। তারা কসমিক রশ্মিকে উচ্চ শক্তির ফোটন ভেবেছিলেন। পরে অবশ্য তারা বুঝতে পারেন এই রশ্মি কোনো ফোটন-মোটন না। কসমিক রে আসলে নিউক্লিয়াস, প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন কিংবা আস্ত পরমাণু (কসমিক রে এর কেবল ১০% ইলেকট্রন), যাদের গতি প্রায় আলোর কাছাকাছি! এসব কণা প্রথমে তারার ভেতরে কিংবা তার আশেপাশে অবস্থান করত। কিন্তু সুপারনোভা কিংবা কিলোনোভার ফলে তৈরি হওয়া শকওয়েভ এদের আলোর কাছাকাছি গতি দেয়, যা এদের বানিয়ে দেয় কসমিক রে!
এখন প্রশ্ন হলো, আলোচনা হচ্ছিল মৌল সৃষ্টির ব্যাপারে, তার মাঝে কসমিক রে ঢুকে পড়ল কেন? কারণ মৌল সৃষ্টিতে এদেরও প্রভাব রয়েছে। তবে কসমিক রে এর মাধ্যমে মৌল সৃষ্টির ব্যাপারটা অনেকটা দূর্ঘটনাময়। মহাশূন্যে চলার পথে কসমিক রে যদি কোনো একটি পরমাণুতে আঘাত হানে, তখন কসমিক রশ্মিতে থাকা মৌল বা নিউক্লিয়াস দু টুকরা হয়ে যায় আর তৈরি হয় নতুন মৌল। তবে একথা প্রযোজ্য কেবল এমন কসমিক রে এর ক্ষেত্রে, যাতে থাকে শুধু নিউক্লিয়াস কিংবা পরমাণু। কিন্তু কসমিক রে যদি শুধু প্রোটন বা নিউট্রন দিয়ে গঠিত হয় আর সেটি যদি কোনো পরমাণুকে আঘাত করে সেক্ষেত্রে আঘাতপ্রাপ্ত পরমাণুর নিউক্লিয়াসের প্রোটন বা নিউট্রন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও নতুন মৌল বা আইসোটোপ তৈরি হতে পারে।
ব্যাপারটা আরেকটু পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য নিচের উদাহরণ দুটির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। প্রথমে কসমিক রে হিসেবে একটা কার্বন পরমাণুকে বিবেচনা করি। একটা কার্বন (কসমিক রে) যখন একটি হাইড্রোজেন পরমাণুকে আঘাত করে তখন কার্বনের নিউক্লিয়াস ভেঙে তৈরি হয় হিলিয়াম, লিথিয়াম আর নিউট্রন। এবারে কসমিক রে হিসেবে চিন্তা করি একটি প্রোটনের কথা। মনে করি, সে আঘাত হানতে চলেছে পৃথিবীতে থাকা একটি কার্বন (Carbon-14) পরমাণুকে। সে আঘাত হেনে একটি নিউট্রনকে যদি সরিয়ে ফেলে জায়গা দখল করতে পারে, তাহলেই হলো! পরমাণুটির পারমাণবিক সংখ্যা একঘর বেড়ে হবে ৭। আর আমরা পাবো নাইট্রোজেন (Nitrogen-14) এর পরমাণু! কসমিক রশ্মির মাধ্যমেই লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরন ছাড়াও আরো অনেকগুলো মৌল সৃষ্টি হয়েছিল।
৭.
প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এমন ৯৪ টি মৌলের উৎপত্তি রহস্যের সমাধান তো হলো। এবার দেখতে হবে বাকি ২৪টি মৌল বিজ্ঞানীরা কেমন করে তৈরি করলেন। তবে প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, কৃত্রিম ভাবে মৌল তৈরির ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি নতুন নয়, এখনো ১০০ বছরও হয়নি। ১৯৩৭ সালে টেকনিশিয়াম (Tc) তৈরির মাধ্যমে শুরু হয় বিজ্ঞানীদের মৌল সৃষ্টির যাত্রা। সর্বশেষ ২০০২ সালে রাশিয়ার ডাবনায় তৈরি হয় ওগানেসন (Oganesson-118), যার পারমাণবিক সংখ্যা ১১৮। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন ল্যাবে চলছে মৌল তৈরির চেষ্টা, ওগানেসনের চেয়েও বেশি পারমাণবিক সংখ্যাবিশিষ্ট পরমাণু তৈরির চেষ্টা! দেখা যাক ভবিষ্যতে আর কোনো পরমাণু তৈরি হয় কিনা! IUPAC অবশ্য ইতোমধ্যেই এদের জন্য সাময়িক কিছু নাম ঠিক করে রেখেছে। যেমন: Ununennium, Unbinilium; নামগুলো বেশ বিদঘুটে মনে হয়।
কৃত্রিম মৌল তৈরি করা হয় পার্টিকেল এক্সিলারেটর, নিউক্লিয়ার রিএক্টর কিংবা সাইক্লোট্রনে। এর মধ্যে দুটি পরমাণুকে এক করে নতুন মৌল তৈরির চেষ্টা করা হয়। তবে একটা জিনিস এখানে বুঝতে হবে যে, এই প্রক্রিয়াটি কিন্তু ফিউশন কিংবা নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস নয়, বোম্বার্ডিং বলা চলে! দুটো অ্যাটমকে প্রচণ্ড গতি দিয়ে একে অপরের সাথে অনেকটা ধাক্কা দিয়ে নতুন মৌল তৈরি করা হয়। তবে নতুন মৌলের সাথে কিছু মুক্ত নিউট্রনও তৈরি হয়।
আমরা এখন ওগানেসন তৈরির পদ্ধতি দেখব। ওগানেসন তৈরির ক্ষেত্রেই আমাদের চোখে পড়বে আরও বেশ কয়টি কৃত্রিম মৌল।
ওগানেসন (Og) তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় ক্যালিফোর্নিয়াম-249 ()। কিন্তু এই ক্যালিফোর্নিয়াম তৈরি করা বেশ কষ্টকর ব্যাপার। এজন্য প্রথমে আমরা নেব ইউরেনিয়াম-238 ()। এটি একটি নিউট্রন ক্যাপচার করে (পার্টিকেল এক্সিলারেটরের ভেতরে) ইউরেনিয়াম-239 () আইসোটোপে পরিণত হয় যা বিটা বিকিরণের মাধ্যমে রূপ নেয় নেপচুনিয়াম-239 () এ। আর নেপচুনিয়াম বিকিরণ করে পরিণত হয় প্লুটোনিয়ামে। এ পর্যন্ত আসবার জন্য ইউরেনিয়ামের পক্ষে একটি নিউট্রন ক্যাপচার করাই যথেষ্ট। কিন্তু সবশেষে ক্যালিফোর্নিয়াম পেতে হলে এবার আর একটা দিয়ে কাজ হবে না। প্লুটোনিয়াম আর নিউট্রনের বোম্বার্ডিং এর সময় প্লুটোনিয়াম-239 () কে এবার চার-চারটি নিউট্রন ক্যাপচার করতে হবে। তবেই সে পরিণত হবে প্লুটোনিয়াম-243 () এ। এরপর আবার বিটা বিকিরণ আর নিউট্রন ক্যাপচারের মাধ্যমে আমরা আমেরনিশিয়াম (Am), কিউরিয়াম (Cm), বার্কেলিয়াম (Bk) হয়ে পাবো কাঙ্খিত সেই ক্যালিফোর্নিয়াম-249 ()।
উপরের সমীকরণটিতে ইউরেনিয়াম-২৩৮ থেকে ক্যালিফোর্নিয়াম-২৪৯ তৈরির ধাপসমূহে সংগঠিত নিউক্লিয় বিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। এখানে (n, ) দিয়ে নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস এবং দিয়ে বিকিরণ বোঝানো হয়েছে।
পার্টিকেল এক্সিলারেটরে এই ক্যালিফোর্নিয়াম আর ক্যালসিয়াম আয়নের বোম্বার্ডিং এর মাধ্যমে পাওয়া যায় ওগানেসন।
কিন্তু ওগানেসনের সুস্থিত ইলেকট্রন বিন্যাস রয়েছে বলে কী হয়েছে? তার নিউক্লিয়াস প্রচণ্ড তেজস্ক্রিয়, অর্ধায়ু মাত্র ০.৮৯ মিলিসেকেন্ড! সে আলফা বিকিরণের মাধ্যমে লিভারমোরিয়াম (Lv), ফ্লোরোভিয়াম (Fl), কোপারনিশিয়াম (Cn)-এ রূপ নিতে নিতে একটা স্থিতিশীল নিউক্লিয়াসের খোঁজ করতে থাকে।
এরপর বা বিকিরণ করে অন্য মৌলে পরিণত হবে
এবার আমরা দেখব সেই ১৯৩৭ সালে তৈরি প্রথম কৃত্রিমভাবে তৈরি মৌল টেকনিশিয়াম তৈরির পদ্ধতি। প্রথম টেকনিশিয়াম তৈরি করা হয়েছিল সাইক্লোট্রনে। মোলিবডেনাম আর নিউট্রনের বোম্বার্ডিং এর মাধ্যমে। মোলিবডেনাম-98 () একটি নিউট্রন ক্যাপচার করে পরিণত হয় মোলিবডেনাম-99 () আইসোটোপে, যা অতিরিক্ত নিউট্রনের বিটা রেডিয়েশনের মাধ্যমে রূপ নেয় টেকনিশিয়াম-99 ()।
এ তো গেল টেকনিশিয়াম কৃত্রিমভাবে তৈরি করার কথা। তবে মনে রাখতে হবে যে, টেকনিশিয়াম হলো প্রাকৃতিক মৌল। অবশ্য টেকনিশিয়াম, নেপচুনিয়াম, প্লুটোনিয়াম এদেরকে অনেকেই প্রাকৃতিক মৌল হিসেবে মর্যাদা না দিয়ে কৃত্রিম মৌলের মর্যাদা দিতেই ভালোবাসেন। তাদের যুক্তি এটি পৃথিবীতে পাওয়া যায় না, ল্যাবে বানানো হয়, তাই কৃত্রিম মৌল। তবে একেবারে যে পৃথিবীতে পাওয়া যায় না, তা নয়। পৃথিবীতেও খুব অল্প পরিমাণে এদের পাওয়া যায়, বিশেষ করে পৃথিবীর অভ্যন্তরে কেন্দ্রমণ্ডলে। আর পাওয়া যায় দূর আকাশের তারাদের মাঝে। কিন্তু প্রায়শই বিভিন্ন কাজে আমাদের এসব মৌল প্রয়োজন হয়। এখন তারাদের থেকেই বা এদের কীভাবে আনব? সেরকম দ্রুত ও উন্নত প্রযুক্তি যে এখনও আমাদের হাতে আসেনি। তাছাড়া পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলে গিয়ে সংগ্রহ করাও অসম্ভব। একারণে এদের ল্যাবে তৈরি করা হয়। তবে এসব মৌল কৃত্রিম না প্রাকৃতিক তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির কারণ আলাদা। এদের প্রকৃতিতে খুঁজে পাওয়ার আগেই বিজ্ঞানীরা তৈরি করেন কৃত্রিমভাবে। এই ঘটনা প্রোট্যাক্টিনিয়াম (Pa), এক্টিনিয়াম (Ac), ফ্রান্সিয়াম (Fr), এস্টেটিন (At), পোলোনিয়াম (Po), প্রোমিথিয়াম (Pm) এই ৬টি মৌলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য! এরাও অনেক জায়গায় প্রাকৃতিক মৌলের বদলে শুধু কৃত্রিম মৌল হিসেবেই পরিচিতি পায়।
৮.
আমাদের এই জগত সংসারের সকল বস্তুই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মৌলের সমন্বয়ে। আমাদের এই মানবদেহও এর ব্যতিক্রম নয়। এটি গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মৌল দিয়ে। আমাদের দেহের প্রধান গঠন উপাদানের মধ্যে রয়েছে পানি, প্রোটিন, ফ্যাট, গ্লুকোজ ইত্যাদি। এদের থেকেই আমরা প্রাথমিকভাবে আন্দাজ করে বের করতে পারি কী কী মৌলের পরমাণু রয়েছে আমাদের প্রত্যেকের শরীরে। পানিতে রয়েছে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন; গ্লুকোজ আর চর্বিতে পাচ্ছি কার্বন, হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। এক প্রোটিনেই রয়েছে সাতটি মৌল- কার্বন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, সালফার, ফসফরাস ও আয়রন। আমাদের দেহের হাড়, দাঁতে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, ক্লোরিন, ফ্লোরিন ইত্যাদি; রক্তে হিমোগ্লোবিনে রয়েছে লোহা। মানবদেহে পারমাণবিক পর্যায়ে চিরুনি তল্লাশি করলে সোনা, রূপা, ইউরেনিয়ামের মতো মৌলও পাওয়া যাবে (এসব ট্রেস এলিমেন্টগুলোর ভর সব মিলিয়ে একজন মানুষের দেহে প্রায় ১০ গ্রাম!) এসবেরই উৎপত্তি বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে, তারার মাঝে, সুপারনোভা সহ আরো বিভিন্ন উপায়ে এবং কীভাবে এদের সৃষ্টি তা আমরা দেখে এসেছি।
তথ্যসূত্র:
- Planck Collaboration; Aghanim, N.; Akrami, Y.; Ashdown, M.; Aumont, J.; Baccigalupi, C.; Ballardini, M.; Banday, A. J.; Barreiro, R. B.; Bartolo, N.; Basak, S. (September 2020). “Planck 2018 results: VI. Cosmological parameters“. Astronomy & Astrophysics. 641.
doi: 10.1051/0004-6361/201833910 - Castelvecchi, D., How gravitational waves could solve some of the Universe’s deepest mysteries, Nature 556, 164-168 (2018)
doi: 10.1038/d41586-018-04157-6 - Muia, F., Big bang: how we are trying to ‘listen’ to it – and the new physics it could unveil, The Conversation, July 15, 2021
https://theconversation.com/big-bang-how-we-are-trying-to-listen-to-it-and-the-new-physics-it-could-unveil-164502 - Stefania Amodeo et al. Atacama Cosmology Telescope: Modeling the gas thermodynamics in BOSS CMASS galaxies from kinematic and thermal Sunyaev-Zel’dovich measurements. Physical Review D, 2021; 103 (6)
DOI: 10.1103/PhysRevD.103.063514 - Coc, Alain; Vangioni, Elisabeth (2017). “Primordial nucleosynthesis”. International Journal of Modern Physics E. 26 (8): 1741002.
doi: 10.1142/S0218301317410026 - Peebles, P. J. E. (1966). “Primeval Helium Abundance and the Primeval Fireball”. Physical Review Letters. 16 (10): 410–413.
doi: 10.1103/PhysRevLett.16.410. - Gary Steigman (2007). “Primordial Nucleosynthesis in the Precision Cosmology Era”. Annual Review of Nuclear and Particle Science. 57 (1): 463–491.
doi: 10.1146/annurev.nucl.56.080805.140437 - H. J. Haubold and A. M. Mathai, “Solar Nuclear Energy Generation and the Chlorine Solar Neutrino Experiment,” Am. Inst. Phys. Conf. Proc. 320, 102 (1994).
- Eddington, A. S. (October 1920). “The Internal Constitution of the Stars”. The Scientific Monthly. 11 (4): 297–303.
doi: 10.1126/science.52.1341.233 - Kennedy, G.M., Matrà, L., Facchini, S. et al. A circumbinary protoplanetary disk in a polar configuration. Nat Astron 3, 230–235 (2019).
doi: 10.1038/s41550-018-0667-x - J. A. Moore, H. Palevsky, and R. E. Chrien, Neutron Capture in Iron, Phys. Rev. 132, 801.
doi: 10.1103/PhysRev.132.801 - Fewell, M. P. (1995). “The atomic nuclide with the highest mean binding energy”. American Journal of Physics. 63 (7): 653–658.
doi: 10.1119/1.17828. - Watson, D., Hansen, C.J., Selsing, J. et al. Identification of strontium in the merger of two neutron stars. Nature 574, 497–500 (2019).
doi: 10.1038/s41586-019-1676-3 - P. Sutter, How neutron star collisions flooded Earth with gold and other precious metals, Space.com, September 27, 2021
https://www.space.com/neutron-star-collisions-gave-earth-precious-metals - Darling, David. “Alpha particle”. Encyclopedia of Science
- Mcclain, D. E.; Miller, A. C.; Kalinich, J. F. (December 20, 2007). “Status of Health Concerns about Military Use of Depleted Uranium and Surrogate Metals in Armor-Penetrating Munitions” (PDF). NATO
- Ralph Spencer, Chris Rapley, A history of radio detection of cosmic-rays, Astronomy & Geophysics, Volume 59, Issue 3, June 2018, Pages 3.33–3.37,
doi: 1093/astrogeo/aty149 - Heiserman, D. L. (1992). “Element 43: Technetium”. Exploring Chemical Elements and their Compounds. New York: TAB Books.
- Perrier, C.; Segrè, E. (1947). “Technetium: The Element of Atomic Number 43”. Nature. 159 (4027): 24.
doi: 10.1038/159024a0
আরো সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
- G. K. Batchelor, An Introduction to Fluid Dynamics (Cambridge University Press, 1967)
- মুহম্মদ জাফর ইকবাল, পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম পাঠ (তাম্রলিপি, ২০১৪)
জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ে প্রথম পড়েছিলাম যে, আমরা সকলেই নক্ষত্রের সন্তান। পাঠ্যবইয়েও বোধ হয় এরকম একটা কথা পড়েছিলাম। ছোটোবেলায় বুঝতামই না কীভাবে আমাদের মধ্যে নক্ষত্রে সৃষ্ট উপাদান রয়েছে। এখন আমি বিষয়টি বুঝেছি। আশা করি আপনারাও বুঝেছেন।
- আবদুল গাফফার, গুপ্ত মহাবিশ্বের খোঁজে (প্রথমা প্রকাশন, ২০১৯)
- Physics Today, American Institute of Physics
- NASA
- Wikipedia
- Kurzgesagt
- Royal Society of Chemistry
- Science Education at Jefferson Lab
তথ্য বহুল লেখা সাথে সুন্দন সাঁজানো, দুটো মিলিয়ে একদম অসাধারণ!
ধন্যবাদ। ব্যাঙাচি পড়ুন বিনামূল্যে।